সারথী নিয়ে উদ্যোক্তা রুমানা আক্তারের সফলতার গল্প !

সারথী নিয়ে উদ্যোক্তা রুমানা আক্তারের সফলতার গল্প !
Spread the love

‘সারথী’ নিয়ে উদ্যোক্তা রুমানা আক্তারের সফলতার গল্প !

‘সারথী’ মানে সঙ্গী। আর এই সঙ্গীকে সাথে নিয়ে চলছে উদ্যোক্তা উম্মে রুমানা আক্তারের উদ্যোক্তা জীবনের পথচলা। তিনি কাজ করছেন ব্লকের তৈরি পোশাক, বিছানার চাদর, পর্দা, কুশন কাভার ইত্যাদি নিয়ে। এই পর্বে আমরা জানবো তার উদ্যোক্তা জীবনের এগিয়ে চলার গল্প।

উদ্যোক্তা উম্মে রুমানা আক্তারঃ

আমি উম্মে রুমানা আক্তার। বাবা মায়ের দুই জন সন্তানের মধ্যে আমিই বড় আর আমার একটি ছোট ভাই রয়েছে। আমার জন্ম ১৯৯৩ সালের ২২ শে ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম জেলায়। বাবা একজন ঔষধ ব্যবসায়ী আর মা একজন গৃহিণী। ২০০৯ সালে এস এস সি দেই। তারপর বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর চাকরি সূত্রে ২০১০ সালে প্রথম ঢাকায় আসি। কিন্তু লেখাপড়ার জন্য শ্বশুর বাড়ির এলাকার একটি কলেজে ভর্তি হই। তারপর শ্বশুর বাড়ি থেকে এইচএসসি দেই ২০১১ সালে ।

▶ আরও পড়ুনঃ আমার উদ্যোক্তা ও শিক্ষা জীবনের গল্প !

২০১২ সালে প্রথম সন্তানের ‘মা’ হই। এজন্য অনার্সে ভর্তি হতে পারিনি। তবে লেখা পড়া বন্ধ করিনি। মেয়েকে নিয়ে ২০১৪ সালে বিএ কমপ্লিট করি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারে। তারপর ঢাকায় মাস্টার্স প্রিলির উদ্দেশ্যে ভর্তি হই মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১৫-১৬ এর ব্যাচ হলেও পরীক্ষা দেই ২০১৮ সালে। তখন ২য় সন্তানের ‘মা’ হই। আমার দ্বিতীয় সন্তানের বয়স তখন মাত্র দু’মাস। আমার এই ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে যখন আমি পরীক্ষা দিতাম তখন নিজের পরীক্ষার চেয়ে সন্তানের চিন্তা বেশি মাথায় থাকতো। ৪ ঘণ্টার পরীক্ষায় প্রতিদিন আমি সাড়ে তিন ঘন্টায় পরীক্ষা দিতে পেরেছিলাম। আমার ছোট সন্তানকে সময় দিতে হতো।

২০১৯ সালে মাস্টার্স এর রেজাল্ট হয়। আর আমি ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হই আলহামদুলিল্লাহ। এভাবেই আমি শেষ করি আমার লেখাপড়া। ২০১৯ এর শুরু থেকে শেষের মধ্যে অনেকগুলো চাকরির অ্যাপ্লিকেশন করি কিন্তু পরীক্ষা দিতে পারি মাত্র ৩ টির। এরপর মহামারী এসে সমস্ত পরীক্ষা, সার্কুলার, অফলাইনের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এই মহামারীর সূত্র ধরেই ২০২০ সালের ২১ ই আগস্ট আমি সারথী নামে একটি পেইজ ওপেন করি। তারপর থেকে আমার অনলাইন ভিত্তিক উদ্যোক্তা জীবন শুরু।

সারথী নিয়ে উদ্যোক্তা রুমানা আক্তারের সফলতার গল্প !
ছবিঃ ব্লকের বেডশীট !

আমার উদ্যোগ শুরু হয় যেভাবেঃ

ছোটকাল থেকেই ভেবেছিলাম জীবনে কিছু না কিছু একটা করবো । কিন্তু নির্ধারণ করতে পারিনি কি করব ? সত্যি কথা বলতে আমার লাইফে এমন কেউ নির্দেশনামূলক কোন বক্তব্য রাখেনি যে হ্যাঁ তুমি এটা করতে পারো। তাই আমিও যথাযথ বুঝে উঠতে পারিনি আমি কি করতে চাই ? এরই মধ্যে এসএসসি পরীক্ষা শেষে বিয়ে হয়ে গেল! তাই নতুন করে স্বপ্ন দেখাটা যেন থেমে গেল। তখন শুধু স্বপ্ন ছিল লেখাপড়াটা যেন অন্ততঃ শেষ করতে পারি। আল্লাহর অশেষ রহমতে একে একে আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করে ফেলি এবং প্রথম স্থান অধিকার করি। ইতিমধ্যেই আমি দুই কন্যা সন্তানের জননী।

▶ আরও পড়ুনঃ ১৫ বছর বয়সী কিশোরী উদ্যোক্তা তাসফিয়া ইসমাত অথৈ !

পরিবার-পরিজন নিয়ে দিনগুলো খুব ভালোই কাটছিল। হঠাৎ নিজের মধ্যেই কোন একটা অপ্রাপ্তি কাজ করা শুরু করলো। তাই অফলাইনেই শুরু করে দেই ছোটখাটো বিজনেস। ভালোই চলছিল আমার সেই ছোট্ট বিজনেস। কিন্তু হঠাৎ করে করোনার থাবা পড়ে আমার গতিরোধ করে। কিছু সময় আমার বিজনেস কে বন্ধ করে রাখি। আর এরই মধ্যে মানসিক চাপে ভুগতে থাকি। কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না ! তখনই মনে হলো অনলাইন ভিত্তিক বিজনেস করলে মন্দ হয় না।

কিন্তু কিভাবে শুরু করবো তা জানা ছিল না। কারণ, অনলাইন সম্পর্কে যা যা করণীয় তা আমি কিছুই জানিনা। আমার নিজের আইডি যেখানে আমি নিজেই ঠিকমত চালাতে পারিনা, সেখানে বিজনেস পেইজ এবং বিজনেস সত্যিই অবিশ্বাস্য। তারপর কয়েকজন পরিচিতজন ও ছোট ভাই এর সাহায্যে অনলাইন ভিত্তিক বিজনেস এর খুঁটিনাটি জানতে শুরু করি। আমার এক পরিচিত আপুর কাছ থেকেও আমি একটি গ্রুপ সম্পর্কে জানতে পারি। গ্রুপটির নাম ছিল ‘উই’

সারথী নিয়ে উদ্যোক্তা রুমানা আক্তারের সফলতার গল্প !
ছবিঃ ব্লকের বিছানার চাদর ।

পরিচিতি পেলাম যেভাবেঃ

প্রথম জার্নিটা ছিল উই থেকেই। এরই মধ্যে আমি একটি পেইজ খুলে ফেলি। কিন্তু পেইজে কি লিখব বা সেই গ্রুপগুলোতে কি লিখবো তা আমার জানা ছিল না ! তখন আমি অনলাইন ভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপের, বিভিন্ন পেইজের যে পোস্ট গুলো ছিল সেগুলো নিয়মিত পড়ার চেষ্টা করি। তারপর ধীরে ধীরে আমি লিখতেও শিখে যাই। নিজের উদ্যোগের কাজগুলোকে আরো ভালোভাবে করার জন্য, আরো ভালোভাবে জানার জন্য অনলাইন ভিত্তিক লেখাপড়া শুরু করি ‘ডিজিটাল স্কীল ফর বাংলাদেশ’ গ্রুপে।

▶ আরও পড়ুনঃ ১৬ বছর বয়সী কিশোরী উদ্যোক্তা নূরে মীম !

এছাড়াও আমি পড়েছি গুগল থেকে ও যারা অভিজ্ঞ কারিগর তাদের কাছ থেকে। ওহহো,আপনাদের তো বলাই হয়নি “আমি কি নিয়ে কাজ করি” ! আমি কাজ করছি কাঠ ব্লক পণ্য নিয়ে। যেসব জিনিস আমি নিজে তৈরি করে বিক্রয় করি তা হলো- পর্দা, বেড কাভার, কুশন কাভার, টেবিল ক্লথ, ডিভান কাভার, শাড়ি, কুর্তি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবী ও বেবি ড্রেস ইত্যাদি।

অনলাইনে বিজনেস শুরু করার ঠিক ১৫ দিনের মাথায় আমার প্রথম বিক্রি হয় ১৯৫০ টাকা। এর দু’দিন পর’ই এক ইউ এন ও অফিসার প্রায় ৬০০০ টাকার অর্ডার দিয়ে বসেন আলহামদুলিল্লাহ। এরপর আর আমাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বিভিন্ন গ্রুপে আমার পেইজে এবং আমার আইডি থেকে প্রতিদিন সেল হওয়া শুরু হলো। আলহামদুলিল্লাহ, আমার বর্তমান ক্রেতার লিস্ট প্রায় ৩০৯ জন। আর এর মধ্যে আমার রিপিট ক্রেতাই সবচেয়ে বেশি। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে আমার পণ্য ৩৭ টি জেলায় পৌঁছে গেছে। আর দেশের গন্ডি পেরিয়ে লন্ডন, ইতালি, ও আমেরিকায়ও পৌঁছে গেছে আমার পন্য়।

সারথী নিয়ে উদ্যোক্তা রুমানা আক্তারের সফলতার গল্প !
ছবিঃ বেডশীট !

আমার পণ্যের কোয়ালিটি ও ডিজাইনঃ

আমার পণ্য আমি কোয়ালিটি মেইনটেইন করে ইউনিক ডিজাইন দিয়ে তৈরি করার চেষ্টা করি। হোম ডেকরের যে পণ্যগুলো তার কাপড় থেকে শুরু করে কাটিং, রং, ডিজাইন সব আমি দেখি আমার ২ জন সহকর্মীসহ। শাড়ি, কুর্তি, থ্রি-পিস যে পোশাকগুলো সেগুলো আমি নিজের হাতে ডিজাইন করি। সেখানে সব থেকে ছোট কাজ হলেও আমি নিজ হাতেই করি। এই কাজগুলো আমি কখনো অন্যের হাতে ছেড়ে দেই না। কারণ, আমি নিখুঁত পরিচ্ছন্ন কাজ করতে ভালবাসি।

উদ্যোগের নাম ‘সারথী’ কেন?

অনেকের ই প্রশ্ন আমার উদ্যোগের নাম সারথী কেন ! আসলে সারথী মানে সঙ্গী। আমার কাজ হোম ডেকর ও পোশাক নিয়ে। এগুলো মানুষের চাহিদার বিশেষ একটি অংশ। যা ছাড়া কোনো মানুষ চলতে পারে না। এই চিন্তাধারা থেকেই আমার সারথী নামটা কে বেছে নেওয়া। চলার পথে সবথেকে যাকে বেশি প্রয়োজন সেই তো সঙ্গী সেইতো সারথী। বর্তমানে আমার এই অনলাইন ভিত্তিক উদ্যোগের বয়স ১৮ মাসের বেশি আলহামদুলিল্লাহ।

▶ আরও পড়ুনঃ সফল নারী উদ্যোক্তা মানসুরা হাসান অর্না !

এই পর্যন্ত আসতে আমার অনেকখানি চড়াই-উৎরাই পার করতে হয়েছে। নিজের ছোট্ট সন্তানদের ঘরে রেখে সারা দিন ব্লক কারখানায় দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করতে হয়েছে। সংসার ও বাচ্চা সামলিয়ে নিজ উদ্যোগকে দাঁড় করানোই আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল। আর আমার এই উদ্যোগের পাশে ছিল আমার সন্তান, আমার স্বামী ও আমার পরিবার পরিজন। যাদের সাপোর্ট ছাড়া আমি কখনোই এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না।

পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি উন্মুক্ত অনলাইন ভিত্তিক প্লাটফর্ম তৈরি করার চেষ্টা করছি। যেখানে প্রায় ৫৬০০ জন নারী ও পুরুষ উদ্যোক্তা কাজ করছেন নির্দ্বিধায়। সকল নারী ও পুরুষ উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে দেশীয় পণ্যের যেমন প্রচার হচ্ছে তেমনি সেলও হচ্ছে। আমার গ্রুপের নামঃ উত্তরবঙ্গ ই- কমার্স জোন (উইজ)

উদ্যোক্তা রুমানা আক্তারের সফলতার গল্প !
ছবিঃ ব্লকের শাড়ি !

আমার স্বপ্নঃ

‘সারথী’ একদিন একটি ভাল মানের ব্র্যান্ড হবে। আর আমার শো-রুম হবে, যেখানে অনলাইন ছাড়াও অফলাইনে ক্রেতাগণ পণ্য ধরে বেছে ক্রয় করতে পারেন। আমার ছোট্ট ই-কমার্স গ্রুপটি একদিন অনেক বড় হবে,যেখানে সর্বস্তরের নারী ও পুরুষ উদ্যোক্তারা কাজ করতে পারবে।

আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাঃ

আমি কুড়িগ্রাম জেলার মেয়ে ও বউ। আমি আমার জেলার মাটি ও মানুষকে বড্ড ভালবাসি। সেই ভালোবাসা থেকেই আমি আমার জেলার মানুষের জন্য কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করতে চাই। কারণ, আমার জেলার মানুষ এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। আমার জেলায় সবথেকে বাল্য বিবাহ বেশি হয়। এই বাল্যবিবাহ রোধ করাই আমার মূল উদ্দেশ্য। এছাড়াও নারীদের আত্ননির্ভরশীল করে গড়ে তোলাই আমার মূল লক্ষ্য। ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তা’আলা যদি চান আমি একদিন সফল হবই। আমি বর্তমানে আমার পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকি। তবে স্বপ্ন দেখি একদিন গ্রামে স্থায়ী বসবাস শুরু করব আমি।

লেখকঃ উম্মে রুমানা আক্তার
উদ্যোগঃ ‘সারথী’
ই-কমার্স গ্রুপঃ উত্তরবঙ্গ ই- কমার্স জোন (উইজ)

Avatar
Jannatun Naime
This is Jannatun Naime. I live in Dhaka, Bangladesh area. My hometown is Chandpur District. I am an Entrepreneur ,Teacher, Blogger and Media Activist. Also a freelancer. These are Graphics Design, Digital Marketing, Video Editing, Content Writing, Content Creator, SEO expert etc with 5 years of experience in the field. I always ‍like to read and write any subject. This website is my personal website. I am a woman who always loves to learn new things and spread it through writing. That’s why I started this blog. The main focus of my writing is to know and write about my country, my district, travel story, freelancing, information and communication technology, science, e-commerce, weaving and crafts, entrepreneurs story, our lifestyle, our cuisine etc. https://jannatunnaime.com
https://jannatunnaime.com/
Top

You cannot copy content of this page