হ্যান্ডপেইন্ট ও খাদি নিয়ে মুসকান নূরের এগিয়ে চলার গল্প !

হ্যান্ডপেইন্ট ও খাদি নিয়ে এগিয়ে চলছেন নারী উদ্যোক্তা মুসকান নূর আঁখি। তিনি পাশাপাশি কাজ করছেন কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদি পন্য নিয়ে। এই পর্বে আমরা তার কাছ থেকে জানবো তার উদ্যোক্তা জীবনে হ্যান্ডপেইন্ট ও খাদি নিয়ে এগিয়ে চলার গল্প ।

উদ্যোক্তা মুসকান নূর আঁখিঃ

আসসালামু আলাইকুম। আমি মুসকান নূর আঁখি। কুমিল্লা জেলার বৃহত্তর লাকসাম উপজেলার একটি সরকারি কলেজের অর্নাস ১ম বর্ষের ব্যাবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী। আমি লাকসামের’ই মেয়ে। বর্তমানে লাকসামেই বসবাসরত রয়েছি এবং লাকসামেই আমি আমার উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছি।

আমার উদ্যোগ শুরু করার কারণঃ

মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড় হয়। স্বপ্ন দেখতে কে না ভালোবাসে। ছোট বেলা থেকেই শুনে এসেছি শুধুমাত্র একটা ছেলেই নাকি শুধু তার মা-বাবার দায়িত্ব নেয়।কারণ, মেয়েরা একটা বয়সের পরে অন্যের ঘরে চলে যায়। তাই মেয়েরা এই দায়িত্বটা নিতে পারে না। তখন থেকেই ভাবতে লাগলাম আমার তো ভাই নেই। তাহলে আমার মা-বাবার দায়িত্ব কে নিবে ! ঠিক সেই মুহুর্ত থেকেই মনের ভিতর এই স্বপ্ন টা লালন করলাম, “আমি আমার আব্বু-আম্মুর শেষ বয়সের ভরসা হবো। যদিও আমি ভীষণ ছোট এবং খুব ক্ষুদ্র একজন মানুষ। জানি না হতে পারবো কি না। তবে আমি বিশ্বাস করি মানুষ চেষ্টা করলে, পরিশ্রম করলেে এবং লক্ষ্য় স্থির করে এগিয়ে চললে একদিন তা পায়।

এ ছাড়াও একটা মেয়ের নিজের একটা পরিচয় থাকা খুবই জরুরি। কারণ, মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ার পর থেকেই মেয়েদের খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয় তাদের কোন পরিচয় নেই। বাবা, ভাই, স্বামী, সন্তান এদের পরিচয়’ই মেয়েদের পরিচয়। সমাজের এই নিয়মগুলো কোন ভাবেই মেনে নিতে পারি নাই। এই না পারা থেকেই আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরু। আমি বিশ্বাস করি আমার এই ক্ষুদ্র উদ্যোগ একদিন আমি বৃহৎ উদ্যোগে পরিণত করতে পারবো, ইনশাআল্লাহ।

আমার উদ্যোগের পন্যঃ

আমি বর্তমানে কাজ করছি হ্যান্ডপেইন্টের সকল প্রকার জিনিস ও আমাদের ঐতিহ্য কুমিল্লার সকল প্রকার খাদি আইটেম নিয়ে। আমার উদ্যোগের নাম – UR Dream Gallery

উদ্যোক্তা জীবনের প্রথম সেলঃ

উদ্যোগ শুরু করার পর থেকেই সকলের ভালোবাসায় আর ভরসায় আমি এগিয়ে যাচ্ছি। আমার উদ্যোগ শুরুর ৭ দিনের মাথায় আমার সেল হওয়া শুরু হয় আলহামদুলিল্লাহ। সেই থেকেই আমি একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার প্রথম সেল হয় ১৭৫০ টাকা ১৮ ই জুলাই ২০২১ সালে।

আমার উদ্যোগের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলিঃ

হ্যান্ডপেইন্ট ও খাদি নিয়ে শুরু হয় আমার উদ্যোগের পথচলা। আমি হ্যান্ডপেইন্ট ও খাদি পন্য নিয়ে কাজ করলেও আমার উদ্যোগের সিগনেচার পন্য মূলতঃ হ্যান্ডপেইন্ট। আর বর্তমানে রাজত্ব চলছে হ্যান্ডপেইন্টের। একটা সময় হ্যান্ডপেইন্টের কাজ করতেন গুটি কয়েকজন শিল্পী। কিন্তু বর্তমানে অনলাইন ব্যবসার সূত্র ধরে নতুন করে হ্যান্ডপেইন্টিং পরিচিতি পেয়েছে সবার কাছে। স্বল্প পরিসরে স্বল্প পুঁজিতে শুরু করা যায় বলে অনেকেই ব্যবসায়ের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছেন এটি কে। তবে তার জন্য রং, তুলি, আঁকাআঁকি সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান থাকা জরুরি। হ্যান্ডপেইন্টের পোশাক সব ধরনের উৎসব ও অনুষ্ঠানের সাথে যায় বলে সবাই এটিকে শখের জিনিস হিসেবে গ্রহন করে।

আমার উদ্যোগের বর্তমান চাহিদাঃ

আমি যেহেতু খাদি নিয়ে কাজ করি তাই এক কালার খাদি পাঞ্জাবির উপরেই আমার হ্যান্ড পেইন্ট করা হয় বেশি। আমার উদ্যোগের সব চেয়ে বেশি চাহিদা হ্যান্ড পেইন্টের। কারণ, বর্তমান বাজারে জনপ্রিয় পোশাকগুলোর মধ্যে হ্যান্ডপেইন্টের পোশাক অন্যতম। হ্যান্ডপেইন্ট শব্দ টা সাধারণ শোনালেও এটি পোশাকের রুপ করে তোলে অসাধারণ।

এখন সাধারণভাবেই মনে প্রশ্ন আসবে হ্যান্ডপেইন্ট কি ? দু’টি শব্দের সমন্বয়ে রয়েছে হ্যান্ডপেইন্ট। হ্যান্ড মানে হাত পেইন্ট মানে রং। হাত আর রংয়ের মাধ্যমে যে কাজ গুলো করা হয় তাকে হ্যান্ড পেইন্ট বলা হয়।

উদ্যোগে যাদের সাপোর্ট পেয়েছিঃ 

আমার উদ্যোগের শুরু থেকে আমি আমার আম্মুর সাপোর্ট পেয়েছি। এর পাশাপাশি আমার বড় বোনের এবং আমার আব্বুরও সাপোর্ট পেয়েছি। তা এখনো পেয়ে পেয়ে যাচ্ছি। এর বেশি আর কারো থেকে সাপোর্ট পাই নি। তবে এখন যত দিন যাচ্ছে আমার ফ্যামিলির সবাই এবং আমার আত্মীয়-স্বজনরা সবাই সাপোর্ট দিচ্ছে এবং সবার ভালোবাসা পাচ্ছি আলহামদুলিল্লাহ।

উদ্যোক্তা জীবনের বাধা-বিপত্তিঃ

উদ্যোগ শুরু হওয়ার পর থেকেই অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে। অনেক কিছুই দেখতে হয়েছে। অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কাপড়ের সঠিক দাম জানতাম না বলে ডাবল দাম দিয়ে কিনে অল্প লাভে সেল করতাম। যার কারণে আমি ২ মাস আমার উদ্যোগ অফ করে রাখি। হতাশায় পড়ে গিয়ে উই এর কয়েকটা আপু, ভাইয়ার সাথে কথা বলে আমি কাপড়ের সঠিক দাম জানতে পারি এবং কাপড় আমদানির সঠিক স্থানের কথা জানতে পারি। আমি আমার উদ্যোগে এটি একটি বাধা হিসেবে না নিয়ে একটি শিক্ষা হিসেবে নিয়েছি এবং তারপর থেকে আমি “উই” তে প্রচুর পরিমানে সময় দিয়েছি এবং চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কারণ, আমি বিশ্বাস করতাম “উই” ই পারে আমার স্বপ্নের কাছে আমাকে দাঁড় করাতে। আলহামদুলিল্লাহ আমার উদ্যোগে আমি ৫ মাসের মধ্যে অর্ধ লাখপতি হই।

আমার উদ্যোগের প্রাপ্তিঃ

যখন ২০২০ সালে কোভিড-১৯ এর জন্য সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়, তখন থেকেই হতাশা শুরু হয়। কিছু একটা করা দরকার ভেবে ভেবেই ২০২০ সাল শেষ হয়ে যায়। ২০২১ সালে এসে টিউশনি শুরু করি। টিউশনির কয়েক মাস পর মনে হলো টিউশনির পাশাপাশি আরো কিছু করা দরকার। তখন পুরো মাসের টিউশনির টাকা খরচ হয়ে মাস শেষে মাত্র ৩০০ টাকা হাতে থাকে। যেহেতু ছোটবেলা থেকেই ড্রয়িং এর উপর আগ্রহ ছিলো। তাই ৩০০ টাকা দিয়ে রং, তুলি কিনে পুরোনো কাপড়ের উপর ডিজাইন করে আমার উদ্যোগের যাত্রা শুরু হয়।

মূলতঃ ৩০০ টাকা দিয়ে উদ্যোগ শুরু করে আজ আমি অর্ধ লাখপতি এবং আমার ডিজাইন করা পোশাক শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। এই পর্যন্ত ৪ টি দেশে আমার ডিজাইন করা পোশাক পাড়ি জমালো আলহামদুলিল্লাহ। যদিও আমি খুব বড় উদ্যোক্তা না খুব ক্ষুদ্র একজন উদ্যোক্তা। তবে এত অল্প সময়ে আমি এত্ত এত্ত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি এবং পজেটিভ রিভিউ পেয়েছি যা আমাকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে। সামনে আরো যত এগিয়ে যাবো তত আমার প্রাপ্তির খাতা আরো বাড়বে ইনশাআল্লাহ। এই প্রত্যাশায় আমি আমার চেষ্টা এবং পরিশ্রম চালিয়ে যাচ্ছি।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাঃ

আমার UR Dream Gallery ভবিষ্যতে সবার মাঝে পরিচিতি লাভ করবে। আমার নামের আগে UR Dream Gallery পরিচয়ে মানুষ আমাকে চিনবে। একটা ব্র্যান্ডে সে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ। এটাই আমার স্বপ্ন, এটাই এগিয়ে চলার অনুপ্রেরনা। আমি এগিয়ে যেতে চাই আমার হ্যান্ডপেইন্ট নিয়ে এবং খাদি নিয়ে ।

লেখকঃ মুসকান নূর আঁখি
উদ্যোগঃ UR Dream Gallery