হ্যান্ড পেইন্ট নিয়ে মরিয়ম মারিয়ার এগিয়ে চলার গল্প! উদ্যোক্তাদের গল্প নারী উদ্যোক্তার গল্প by Jannatun Naime - July 13, 2022July 13, 20220 Spread the love হ্যান্ড পেইন্ট নিয়ে মরিয়ম মারিয়ার এগিয়ে চলার গল্প! হ্যান্ড পেইন্ট আমাদের দেশীয় শিল্পের এক অন্য়তম ধারক ও বাহক। তাই দেশীয় শিল্পের এই ঐতিহ্য রক্ষার্থে ক্ষুদ্র উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছেন আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা। তাদের মধ্য়ে তেমন ই একজন নারী উদ্যোক্তা মরিয়ম মারিয়া। এই পর্যায়ে আমরা তার কাছ থেকেই জানবো হ্যান্ড পেইন্ট নিয়ে তার এগিয়ে চলার গল্প। উদ্যোক্তা মরিয়ম মারিয়াঃ আমি মরিয়ম মারিয়া। আমি একজন সাধারণ পরিবারের মেয়ে। আমি পরিবারের বড় সন্তান। নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলায় আমার জন্ম। আমি ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম। এরপর কিছু সমস্যার কারণে আর অনার্সে ভর্তি হতে পারিনি। ইনশাআল্লাহ আবারও পড়াশোনা চালিয়ে যাবো। তারপর আমি একটি উদ্যোগ শুরু করি। আর তা শুরু করেছি হ্যান্ডপেইন্টের পন্য শাড়ি,পাঞ্জাবী, থ্রি-পিছ, কাঠের গহনা, শাড়ির কম্বোসেট ইত্যাদি নিয়ে। আমার উদ্যোক্তা হওয়ার কারণঃ ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি খুব পছন্দ করতাম। তখন থেকেই চাইতাম, যদি আমি ডিজাইনার হতে পারতাম! এভাবেই স্বপ্ন দেখতে দেখতে স্কুল-কলেজ জীবন শেষ করি। কিন্তু তখনও পর্যন্ত স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেল ! হঠাৎ করে কোন একটা দূর্ঘটনার কারণে আমার পুরো পৃথিবীটা উলট-পালট হয়ে যায়। তখন থেকেই শুরু হয় একাকিত্ব। শুরু হতে থাকে অবহেলা। এমন একটা সময় এসে দাঁড়ায় মনে হয় পরিবার আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী কম-বেশি সবার কাছে আমি বোঝা। ঠিক তখন থেকেই পড়াশোনা বন্ধ করতে হয়। তখন কি করবো, কি করলে ভালো লাগবে, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শুধু মনে হয়েছিল নিজেকে কোন কাজের মাধ্যমে ব্যস্ত রাখলে একটু হলেও হয়তো একাকিত্ব দূর করতে পারবো। ভাবতাম একটা চাকরি করবো। কিন্তু কে দিবে আমাকে চাকরি? এইচ.এস.সির রেজাল্ট দিয়ে। একদিন হঠাৎ করে এই হ্যান্ডপেইন্টের বিষয়টা কোথায় যেন খেয়াল করি। তখন আমি একটু সাহস খুঁজে পাই। ভাবলাম আমিওতো কিছুটা আঁকাআঁকি করতে পারি। চাইলে আমিও আমার প্রতিভাটা কাজে লাগাতে পারি। আমার এই ভাবনার কথাটা সর্বপ্রথম আমার এক বান্ধবীকে জানাই। সে উৎসাহ দেয় ঠিকই। কিন্তু আমার কাছে তখনও কেনো যেন মনে হচ্ছিল আমি কি আদৌ পারবো? তা ভাবতে ভাবতে অনেকগুলো দিন কেটে যায়। ছবিঃ হ্যান্ড পেইন্টের শাড়ি! কারণ, তখনও আমি অনেক শূন্যতায় ছিলাম। এরপর হঠাৎ একদিন আমি আমার হাইস্কুলের একজন বন্ধুর সাথে ফোনে কথা বলার সময় ওকে আমার উদ্যোগের কথাটা জানাই। সে কথাগুলো শুনে আমাকে অনেক উৎসাহ দেয়। সে বলে, ইনশাআল্লাহ তুমি পারবে, শুরু করে ফেলো। তখন আমি তাকে বলি, আমার তো এই হ্যান্ডপেইন্ট সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা নেই। তারপর সে তার পরিচিত এক মেয়ের সাথে ফেইসবুকে আমাকে যুক্ত করে দেয়। তিনিও হ্যান্ডপেইন্টের ই কাজ করেন। আমি চেয়েছিলাম তার কাছ থেকে সরাসরি কাজটা শিখতে। কিন্তু তারপর কিছু সমস্যার কারণে তার থেকে সরাসরি কাজটা শেখা হয়নি। সে আমাকে ফেইসবুকে একটা হ্যান্ডপেইন্ট রিলেটেড একটি গ্রুপে এড করায়। সেই গ্রুপে সবার কাজ দেখে আমার ভিতরের সাহস টা আরো বেড়ে যায়। আমার হ্যান্ড পেইন্ট উদ্যোগঃ আমার উদ্যোগের নাম- “নিপুনতা : Nipunota By Moriam”। আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরু করেছি হ্যান্ডপেইন্ট দিয়ে। তার মধ্যে রয়েছে হ্যান্ডপেইন্টের পোশাক, হ্যান্ডমেইড গহনা, কাঠের ট্রে, শাড়ির কম্বো সেট ইত্যাদি। অনেক স্বপ্ন আর অনেক আশা নিয়েই আমার এই উদ্যোগ শুরু করি। এই উদ্যোগে রয়েছে নিজের একান্ত একটি পরিচয় গড়ে তোলা। যার মাধ্যমে সবাই আমাকে চিনতে পারবে। সেই লক্ষ্যেই “নিপুনতা : Nipunota By Moriam“এর প্রতিষ্ঠা। নিজস্ব অর্জনে পরিচয় গড়ে তুলে মাথা উঁচু করে বাঁচবো ইনশাআল্লাহ। উদ্যোগের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলিঃ হ্যান্ডপেইন্ট পোশাকঃ কাপড়ের সৌন্দর্য বর্ধণ করতে শিল্পীর রং তুলির জনপ্রিয়তাও কম নয়। রং আর তুলির স্পর্শে বর্ণিল হয়ে উঠে পরনের পোশাক। তবে হ্যান্ডপেইন্ট শাড়ির নিতে হয় একটুখানি বাড়তি যত্ন। হ্যান্ডপেইন্ট শাড়ি বারবার না ধোয়াই ভালো, যদি একান্তই বাড়িতে ওয়াশ করতে হয় তাহলে কম ক্ষারযুক্ত লিকুইড ডিটারজেন্ট ব্যবহার করতে হবে। সরাসরি আয়রন করা যাবেনা। বরং উল্টো পিঠে অথবা পাতলা কাপড় হ্যান্ডপেইন্ট কাপড়ের উপর রেখে আয়রন করতে হবে। নতুন হ্যান্ডপেইন্ট শাড়ি কেনার পর কয়েক দিন হালকা রোদে শুকাতে হবে। সাধারণত হ্যান্ডপেইন্টের শাড়ি বা পোশাকের দাম অন্যান্য হাতের কাজের পোশাকের মতোই কিছুটা দামী হয়ে থাকে। কারণ, একটি পোশাক পুরোপুরীভাবে পেইন্ট করতে শিল্পীর অনেকটা পরিশ্রম থাকে। এছাড়াও একটি পোশাক তুলে ধরে শিল্পীর সৃজনশীল সত্ত্বাকে। আর এই সব দিক বিবেচনা করেই পোশাকের দাম নির্ধারিত হয়ে থাকে। কথায় আছে, জিনিস যেটা ভালো দাম তার একটু বেশিই হবে। এজন্যই সবার পছন্দের শীর্ষে এখন হ্যান্ডপেইন্ট এর শাড়ি। ছবিঃ হ্যান্ড পেইন্টের পাঞ্জাবী ! হ্যান্ডপেইন্টের কাঠের গহনাঃ সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বদলে যাচ্ছে অনুষঙ্গ। গয়নার ব্যাপারটাও তাই। সোনা-রুপার গয়না তো আর রোজ রোজ পরা যায় না। সব ধরনের পোশাকের সঙ্গে তাই কাঠের তৈরি গয়না এখন ‘ফ্যাশনে ইন’। খানিকটা সৌন্দর্য ভাব আনতেও হ্যান্ড পেইন্ট এর কাঠের গয়নার তুলনা হয় না। কাঠের হ্যান্ডপেইন্ট করা গয়নার সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য হলো যেকোনো সময়ে যেকোনো পোশাকের সঙ্গে খুব সহজেই মানিয়ে যায়। এসব গয়নায় রঙের আধিক্য থাকে অনেক বেশি। ফ্যাশনের পাশাপাশি যা মনকে রাঙিয়ে তোলে আপন রুপে। কাঠের ট্রেঃ আমরা বাঙালীরা মেহমান আপ্যায়নে খুবই আন্তরিক। মেহমানদেরকে সব সময় ঘরের সুন্দর জিনিস দিয়ে তাদেরকেে আপ্যায়ন করতে পছন্দ করি।কাঠের ট্রে তার মধ্যে অন্যতম ইউনিক একটি পণ্য যা পরিবেশবান্ধবও বটে। শাড়ির কম্বোসেটঃ প্রিয়তমাকে উপহার দিতে কে না ভালোবাসে ! তার পছন্দের রঙের শাড়ির সাথে এক সেট মানানসই জুয়েলারি, কানের দুল, কৃত্তিম ফুলের গাজরা, রঙ-বেরঙের চুড়ি এগুলো সবই এক সাথে একটি কম্বো সেটে পেয়ে গেলে মন্দ হয় না। তাই না? সেই ভাবনা থেকেই আমি কম্বোসেট তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছি । আমার উদ্যোগের বর্তমান চাহিদাঃ পহেলা বৈশাখ, বসন্ত, ঈদ, পূজা ইত্যাদি প্রাণের উৎসবে বাঙালীর এখন সবচেয়ে বেশি পছন্দের পোশাক হলো হ্যান্ডপেইন্ট পোশাক। শুধু কি তাই ! আজকালকার নতুন প্রজন্ম নিজেদের বিবাহের মত গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতেও গায়ে জড়াচ্ছে হ্যান্ড পেইন্ট এর পোশাক ও গহনা। যেখানে বেনারশি ছাড়া বিয়ের কথা চিন্তাই করা হতো না মাত্র কয়েকবছর আগে। এভাবেই দেশীয় পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। অনলাইন উদ্যোক্তাদের হাত ধরেই অনায়াসে এসব পোশাক পাড়ি জমাচ্ছে দেশ ও দেশের বাহিরে। ছবিঃ হ্যান্ড পেইন্টের গহনা। উদ্যোগে যাদের সাপোর্ট পেয়েছিঃ আমার উদ্যোগটি শুরু করি নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য, একাকিত্ব দূর করা জন্য। তারচেয়েও বড় কথা হলো নিজের একটা পরিচয় তৈরি করা। আমার পরিবারের মানুষ হয়তো প্রত্যক্ষভাবে আমাকে সাপোর্ট না করলেও পরোক্ষভাবে ঠিকই সাপোর্ট করে। উনারাও চায় আমি যেন নিজেকে কোনো কাজের মাধ্যমে ব্যস্ত রাখতে পারি। পরিবারের পাশাপাশি আমার বন্ধুদের ভূমিকাও অনেক। আমার খুব কাছের একজন বন্ধুর কাছ থেকে সব দিক থেকে মানসিক সাপোর্টটা খুব পেয়েছি। তা কখনো ভুলতে পারব না। আমার আরো একজন বন্ধুর কাছ থেকে সব দিক দিয়ে সাপোর্ট পেয়েছি। আমার পেইজ (“নিপুনতা : Nipunota By Moriam“) ওপেন করা থেকে শুরু করে এর পিছনে সে শারীরিকভাবেও অনেক পরিশ্রম করছে। আমি ওর কাছে অনেক অনেক কৃতজ্ঞ ! উদ্যোক্তা জীবনের বাঁধা বিপত্তিঃ হ্যান্ডপেইন্ট এর কাজ শুরুর দিকে বুঝতে খুব কষ্ট হতো, কিভাবে কাজ শুরু করবো ! কোন ধরনের কাপড়ে কিভাবে রং করবো, কাপড় কোনটা কি,কাপড়ে কতটুকু মাপ নিয়ে রং করতে হয় কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। অনেক অসুবিধা হতো। তারপর বিভিন্ন হ্যান্ডপেইন্টের পেইজ, গ্রুপ, অভিজ্ঞ আপু-ভাইয়াদের কাজের ভিডিও দেখে তাদের সাথে যোগাযোগ করি। সময় দিয়ে তাদের থেকে অনেক কিছুই জানার চেষ্টা করি। সেই থেকেই আস্তে আস্তে পথ চলা শুরু। উদ্যোক্তা জীবনের প্রথম অর্ডারঃ আমার করা প্রথম কাজ, প্রথম অর্ডার হলো শাড়ি। এই শাড়ির অর্ডার দিয়েই শুরু করি আমার প্রথম ভালোলাগা, প্রথম ভালোবাসা, আমার স্বপ্ন, আমার উদ্যোগ।অর্ডারটা যিনি করেছিলেন তিনি খুব পরিচিত একজন ছিলেন। তার কথা ছিল আমার উদ্যোগ এর প্রথম অর্ডারটা তিনিই দিবেন। সেদিন আমার কাছে সেটা অনেক অনেক বড় পাওয়া ছিল। সেদিন থেকেই শুরু আমার নতুন পথ চলা । ছবিঃ শাড়ি ! আমার উদ্যোগের প্রাপ্তিঃ ১০ই সেপ্টেম্বর ২০২১ সালে প্রথম অর্ডারের কাজ শুরু করি। অর্ডারটি ছিল একটি হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি। বলা হয়েছিল আমি যেন আমার মতো করে ডিজাইনটি করি। আমি ঠিক তাই করি। তার খুব পছন্দ হয়েছিল আলহামদুলিল্লাহ। আমার করা প্রথম শাড়ির ডিজাইনের এখনো পর্যন্ত ৫টা শাড়ি কমপ্লিট করি। এই মুহূর্তে এটা আমার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। আমার করা সর্বপ্রথম অর্ডারের পারিশ্রমিক ছিলো ১০০০ টাকা। সেদিন যে কি আনন্দ হয়েছিল তা বলে বোঝাতে পারবো না। পরিবারের সদস্যদের জন্য ছোট ছোট উপহার কিনে দেওয়াটা, তাও নিজের পারিশ্রমিক দিয়ে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আমার কাছে আর কিছুই নেই আলহামদুলিল্লাহ। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাঃ আমার এই ক্ষুদ্র উদ্যোগ “নিপুনতা : Nipunota By Moriam” একদিন দেশের গন্ডী ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে সমাদৃত হবে। আরো বৃহত্তর হবে আমার এই স্বপ্নের পথচলাইনশাআল্লাহ। লেখকঃ মরিয়ম মারিয়া উদ্যোগঃ নিপুনতা : Nipunota By Moriam