সফল নারী উদ্যোক্তা মানসুরা হাসান অর্না ! উদ্যোক্তাদের গল্প নারী উদ্যোক্তার গল্প সফল উদ্যোক্তার গল্প by Jannatun Naime - October 5, 2021June 20, 20220 Spread the love সফল নারী উদ্যোক্তা মানসুরা হাসান অর্না ! সফল নারী উদ্যোক্তা মানসুরা হাসান অর্না ! যিনি সংসারের পাশাপাশি মাত্র ‘চার’ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেছেন তার উদ্যোক্তা জীবন। তার উদ্যোগে রয়েছে হ্যান্ড পেইন্টের তৈরি করা ডিজাইনের শাড়ি ও খাদি পাঞ্জাবি। এই পর্বে আমরা তার কাছ থেকে জানবো, কিভাবে তিনি উদ্যোক্তা জীবন শুরু করেছেন এবং সফল হয়েছেন ! সফল নারী উদ্যোক্তা মানসুরা হাসান অর্নাঃ আসসালামু আলাইকুম । আমি মানসুরা হাসান অর্না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর থানার মেয়ে। থানা বাঞ্ছারামপুর হলেও পড়াশোনা কমপ্লিট করেছি কুমিল্লা জেলার হোমনা থানায়। দুলালপুর চন্দ্রমনি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করার পর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছি রেহানা মজিদ মহিলা কলেজ থেকে । বি.এ শেষ করেছি বিয়ের পর । ছোট বেলা থেকেই নিজে কিছু করার ইচ্ছে ছিল ! পড়াশোনার পাশাপাশি আমি সবসময়ই টিউশনি করার চেষ্টা করতাম । স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম হলেও আমি কখনো নিজের চাওয়া-পাওয়াগুলো তাদের ওপরে চাপিয়ে দিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করতাম না। স্বপ্ন দেখতাম নিজে কিছু করার। সেই স্বপ্নের বীজ টা মনের মধ্যে সবসময় গেঁথে রেখেছিলাম। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় ঘর আলো করে ছেলে আসে আমাদের। তারপর আমার টিউশনি বন্ধ হয়ে যায় । সময়টা ২০১৯ সাল। তখন আমার ছেলের বয়স পাঁচ মাস। চিন্তা করলাম এখন কি করা যায় ! তখন আমার আব্বুর সহযোগিতায় বাসায়ই ছোট্ট একটা পার্লার দেই। আলহামদুলিল্লাহ ভালোই সাড়া পাচ্ছিলাম মানুষের কাছ থেকে। ২০২০ সালে যখন করোনার প্রকোপ পৃথিবীতে শুরু হলো তখন আমাদের দেশেও কঠোর লকডাউন জারি হলো। করোনায় আমার পার্লার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। আর তখনই আমার উদ্যোগের সূচনা হলো। আলহামদুলিল্লাহ সেই থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি। আজ আমি একজন সফল উদ্যোক্তার পথে হাঁটছি । ছবিঃ উদ্যোক্তা মানসুরা হাসান অর্না ! হ্যান্ডপেইন্ট নিয়ে কেন কাজ করিঃ আমার উদ্যোগের নাম Mansura art Gallery । ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে তার যাত্রা শুরু। আসলে বাঙালি সবসময়ই শৌখিন। পোশাকের ক্ষেত্রে বাঙালিয়ানায় একচুল ছাড় দিতেও কেউ রাজি নয়। সেই ভাবনা থেকেই হ্যান্ডপেইন্ট নিয়ে কাজ করা শুরু করলাম। আমি গ্রামে বসবাস করি । উপজেলা পর্যায়েও তখনও মানুষের হ্যান্ডপেইন্ট সম্পর্কে তেমন কোনো ধারনা ছিলনা। আমিই প্রথম আমাদের উপজেলায় হ্যান্ডপেইন্ট কে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেই । আর তাই খুব সহজেই আমার হাতের কাজ এবং কাপড়ের মান তাদের কে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। হ্যান্ডপেইন্ট পোশাক যে কোনো সাধারণ পোশাক থেকে আলাদা সৌন্দর্য বহন করে। যে কোনো বয়সের সাথে সহজেই মানিয়ে যায় হ্যান্ডপেইন্ট পোশাক । হ্যান্ডপেইন্ট পোশাক সবসময়ই আলাদা সৌন্দর্য এনে দেয়। সেই সাথে শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় একটা শৈল্পিক ড্রেস জনমনে উৎসাহের সৃষ্টি করে। প্রথম একটা শাড়ি পেইন্ট করার পর সাথে সাথেই আমার স্কুল ফ্রেন্ড সেটার অর্ডার কনফার্ম করে ফেলে। সেই থেকেই হ্যান্ডপেইন্ট নিয়ে প্রফেশনালি কাজ করা শুরু। আলহামদুলিল্লাহ এখনো সফলতার সাথে ধরে রেখেছি । উদ্যোক্তা জীবন বেছে নেয়ার কারনঃ লেখাপড়া শেষ করে আট দশ জনের মতো চাকরি করবো এটাই পরিবার প্রত্যাশা করেছিলো আমার কাছে। আমারও ছোট বেলা থেকেই নিজে কিছু করার স্বপ্ন ছিল। তাই বলে উদ্যোক্তা হবো সেটা কখনো ভাবিনি। সব পরিকল্পনা পাল্টে যায় Women and E-commerce (we) তে জয়েন হওয়ার পর। স্বপ্ন দেখতে শুরু করি উদ্যোক্তা হওয়ার। নিজের সুপ্ত প্রতিভাকে মেলে ধরবো পৃথিবীর সামনে। আর সেই সাথে মনোবল আরো দৃঢ় হলো ছেলে হওয়ার পর। কারণ, চাকরি করলে অবশ্যই বাইরে যেতে হবে। আর বাইরে গেলে সন্তানকে কাছে পাবোনা। একমাত্র সন্তান আমাকে ছাড়া বড় হোক সেটা আমি মা হিসেবে কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। তারপর চিন্তা করতে লাগলাম কি দিয়ে শুরু করবো। যেহেতু ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকিতে পারদর্শী ছিলাম তাই এই পেশায় আসতে খুব একটা বেগ পোহাতে হয়নি আমাকে। শেষমেষ শুধুমাত্র সন্তানের জন্যই উদ্যোক্তা জীবনে পদার্পন করলাম । ছবিঃ হ্যান্ডপেইন্ট পাঞ্জাবী ! উদ্যোক্তা জীবনের বাধা বিপত্তিঃ উদ্যোক্তা জীবন মানেই লড়াই। একদমই সুখের নয়। আমরা সবাই সফলতা দেখি। তার পেছনের গল্প জানিনা। কিংবা জানার চেষ্টাও করিনা। আজকের এই সফলতার পেছনে রয়েছে রাত-দিন এক করে কাজের পর কাজ । শত শত নিদ্রাহীন রাত্রির ফল এই সফলতা। মান-অপমান আরো কত কি। রাত জেগে কাজ করা। এমনও হতো সকাল বেলা নাস্তা করারও সময় থাকতো না। বেশির ভাগ সময়ই তাড়াহুড়ো করে ক্রেতার হাতে তার কাঙ্ক্ষিত পন্য পৌছে দেয়ার ফল হিসেবেই হয়তো আজকের এই জায়গায় আমি আমাকে দেখতে পেয়েছি । মাত্র ৪ হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে ৬ মাসে লাখপতি হয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ। সবাই ভাবে লাখ লাখ টাকা পুরোটাই হয়তো আমার একাউন্টে জমা করি। কিন্তু না ৪ হাজার টাকা থেকে ১ লাখের ঘর ছোঁয়া অতটাও সহজ ছিলোনা আমার। একটা পান্জাবি সেল করে সেই টাকা দিয়ে আরো ৩ টা কিনেছি। আর এভাবেই এই পর্যন্ত বিজনেস কে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। আমি উদ্যোক্তা জীবনে অনেক বাধার সম্মুক্ষীন হয়েছি। এখনো যে হচ্ছিনা তা কিন্তু নয়। তাই বলে থেমে থাকিনি কখনো। জীবনে বাধা বিপত্তি আসবেই। তাই বলে হেরে যাওয়া কখনো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। উদ্যোক্তা জীবনে যাদের সাপোর্ট পেয়েছিঃ আমার উদ্যোগের শুরুতেই আমি আমার পরিবারকে পাশে পেয়েছি। তারা সবসময়ই পাশে থেকে আমাকে সাপোর্ট করেছে। সবার আগে যার কথা না বললেই নয় সে হলো, আমার ছোট ভাই বাসির আর আমার হাজবেন্ড মেহেদী। আমার ভাই আমার পেইন্টিং এর যাবতীয় জিনিসপত্র কিনে দিয়েছে। পেইজে সর্বপ্রথম আমার ভাই ই ইনভাইট দিয়েছে তার বন্ধুদেরকে। মানুষিক যতটা সাপোর্ট দরকার তার সবটাই ও আমাকে দিয়েছে। যদিও বয়সে আমার ছোট, কিন্তু বড় ভাইও বোনের পাশে এভাবে থাকতে পারে কিনা আমার জানা নেই। ছবিঃ হ্যান্ডপেইন্ট শাড়ি ! আমি তাকে যখন যেভাবে চেয়েছি সেভাবেই পাশে পেয়েছি। যখন যা প্রয়োজন সে আমাকে দিয়েছে। এমনকি আমার বিজনেস যখন মাঝ পথে থমকে যাচ্ছিলো, সে তখন নিজের খরচের ১০ হাজার টাকা আমার বিজনেসের জন্য দিয়ে দেয়। তারপর আসি আমার হাজবেন্ডের কথায়। সে একজন ফার্মেসিস্ট হয়েও আমার পন্যের হোম ডেলিভারি করেছে আমাদের উপজেলায়। সে পাশে থেকে সাপোর্ট না দিলে হয়তোবা আমার এই উদ্যোক্তা জীবন চলমান রাখতে পারতাম না। আমার উদ্যোগের জন্য আমার হাজবেন্ড মানুষের নানা কথার স্বীকার হয়েছে। কিন্তু কখনোই আমাকে একা ছাড়ে নি। তারপর পাশে ছিলো আমার দেবর, সেও আমার ছোট ভাই। সে আমাকে কাপড় সংগ্রহে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। আর যাদের কথা না বললেই নয়, তারা হলেন আমার বাবা- মা। তারা ছিলো আমার ঢাল স্বরুপ। এত মানুষের সমালোচনার ঝড়েও তাদের মনোবল এতটুকুও ক্ষুন্ন হয়নি। তারা সবসময়ই বলতো আমরা তোমার পাশে আছি। আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়িও কখনোই আমাকে বাধা দেয়নি। সে দিক থেকে আমি ভাগ্যবতীই বলা যায়। তাদের সাপোর্ট আর ভালোবাসায় আজকে আমি এই জায়গায়। তাদের জন্যই আমি বাংলাদেশের ২৯ টি জেলাসহ দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে ৫ বার আমার হ্যান্ডপেইন্ট পোশাক পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি । সর্বোপরিঃ সবশেষে বলতে চাই, যে কোনো কাজ করতে গেলে বাধা আসবেই। তাই বলে পিছপা হওয়া চলবে না। শত বাধা টপকিয়ে সামনে নির্ভিগ্নে এগিয়ে যাওয়াই উদ্যোক্তার বৈশিষ্ট্য। আত্নবিশ্বাসী হয়ে এগিয়ে গেলে বার বার ব্যর্থ হওয়ার পরেও সফলতা একদিন ধরা দেবেই। ধৈর্য্য উদ্যোক্তাদের একটি অন্যতম গুন। ধৈর্য্য ধরে এগিয়ে যাওয়াই একজন সফল উদ্যোক্তার মূলমন্ত্র হওয়া উচিৎ। সমস্ত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে আমিও পেরেছি নিজের একটা আলাদা পরিচয় গড়ে তুলতে। এখনো আরো বহুপথ পাড়ি দেওয়া বাকি। ইনশাআল্লাহ একদিন সমস্ত সমালোচনা পেছনে ফেলে সফল হবো আমিও। লেখকঃ উদ্যোক্তা মানসুরা হাসান অর্না উদ্যোগঃ Mansura art Gallery