হ্যান্ডপেইন্টিং নিয়ে সানজানা ফারহার এগিয়ে চলার গল্প ! উদ্যোক্তাদের গল্প নারী উদ্যোক্তার গল্প by Jannatun Naime - April 10, 20220 Spread the love হ্যান্ডপেইন্টিং নিয়ে সানজানা ফারহার এগিয়ে চলার গল্প ! হ্যান্ডপেইন্টিং আমাদের দেশীয় শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন । আর সেই শিল্প নিয়েই কাজ করছেন নারী উদ্যোক্তা সানজানা ফারহা প্রমি। এই পর্বে আমরা তার কাছ থেকেই জানবো তারই এগিয়ে চলার গল্প। উদ্যোক্তা সানজানা ফারহা প্রমিঃ আমি সানজানা ফারহা প্রমি। আমি একজন সাধারণ পরিবারের মেয়ে। পরিবারের বড় সন্তান। কুমিল্লা জেলার বৃহত্তর লাকসাম উপজেলায় আমার জন্ম। বর্তমানে আমি লাকসাম উপজেলার একটি সরকারি কলেজে অনার্স ১ম বর্ষে অধ্যায়ন করছি। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি বেসরকারি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছি, সাথে টিউশনি। আমার নতুন উদ্যোক্তা জীবন শুরু করেছি হ্যান্ডপেইন্টিং এর সকল আইটেম, হ্যান্ড মেইড কাঠের গহনা ও রুম ডেকোরেশন করার জন্য ক্যানভাস / সুপারি পাতার প্লেট পেইন্টিং ইত্যাদি নিয়ে। আমার উদ্যােক্তা জীবনে যাওয়ার কারনঃ ছোটবেলা থেকেই আঁকাআকি নিয়ে ভীষণ আগ্রহ ছিলো আমার। বড় বড় আর্টিস্টদের দেখে ভাবতাম আমিও তাদের মতো হবো একদিন। এভাবেই স্বপ্ন দেখতে দেখতে চলে গেলো স্কুল, কলেজের জীবন। কিন্তু স্বপ্ন পূরনের মাধ্যম আমি আর পাইনি। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই এলো পুরো বিশ্ব জুড়ে করোনা। তখন পুরো পৃথিবীই যেন কান্নায় হাহাকার করছিলো। শুরু হলো মাস জুড়ে লকডাউন। সারাক্ষণ বাসায় শুইয়ে বসেই পড়ে থাকতাম। এমন একটি সময় ছিলো তখন বন্ধু-বান্ধবসহ সব কাছের মানুষগুলোও দূরে সরে যায়। পড়াশুনাটাও তৎক্ষণিকের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে আমার খুব প্রিয় দু’টি মানুষ পৃথিবী থেকে আমাদের ছেড়ে চলে যান। আমার দাদা ও আমার নানা ভাই। শোকে যেন মরিয়া হয়ে উঠি। কিভাবে নিজেকে সামলাবো সত্যিই জানা ছিলো না। লকডাউনে পুরো পৃথিবী তখন স্তব্ধ। পুরো পরিবারের মাথা হলেন আমার বাবা। এমন সময় বাবার ইনকাম সোর্সটাও বন্ধ হয়ে যায়। তখন এক প্রকার মানসিক রোগী হয়ে গিয়েছিলাম আমি। একাকিত্ব যেন গলা চিপে মারছিলো। কি করবো, কোথায় যাব ! মাথায় শুধু ঘুরছিলো আমার একটা চাকরি দরকার ! কিন্তু কে দিবে আমায় চাকরি? এইচএসসি টাও তো দিতে পারলাম নাহ। প্রত্যেকটি দিন যেন বিশ খেয়ে হজম করতাম। ছবিঃ কাঠের গহনা ! অন্যদিকে ফেইসবুকে প্রতিনিয়তঃ দেখতাম কেউ বসে নেই এই মহামারীতে। সবাই কিছুনা কিছু করেই যাচ্ছে। সেই মুহুর্তে আমি আরো অনুপ্রাণিত হই বাংলাদেশের সেরা একটি ই – কমার্স সাইট উইমেন ই-কমার্সে। এখানে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি বিভাগ, জেলা, উপজেলা থেকে নারীরা কাজ করছে। এক জনকে দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে আরেক জন। তখন ভাবলাম আমি আমার নিজের প্রতিভাকে কিছুর মধ্যে দিয়ে কাজে লাগাবো। সে থেকে নিজের আঁকাআঁকির প্রতিভাটাকে নিজের উদ্যােক্তা জীবন হিসেবে বেছে নেই। এছাড়াও নিজের প্রতিও প্রতিনিয়ত জিদ ছিলো। সবাই যদি পারে আমি কেন পারবো না ! আমাকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। কারণ আমি মনে করি, প্রত্যেকটি মেয়ের ই একটি নিজস্ব পরিচয় থাকা উচিত। নিজেকে এমনভাবে গড়ে তোলা উচিত যাতে কারো কাছে ছোট হয়ে হাত না পাত তে হয়। ছেলে হইনি তো কি হয়েছে, মেয়ে হয়েও একজন ছেলের মতো দায়িত্ব পালন করতে পারে একটি মেয়েও। এই অদম্য আত্মবিশ্বাস থেকেই ২০২১ সাল থেকে আমার উদ্যােক্তা জীবন শুরু হয়। আমি জানি আমি পারবো। যে মানুষগুলোর থেকে প্রত্যেকটি মুহুর্তে শুনেছি আমায় দিয়ে কিছু হবে না। একদিন তাদের গর্ব হয়ে দাঁড়াবো ইনশাআল্লাহ। আমরা নারী, মেয়ে, মা জাতি। আমরা কোনো অংশেই কম নই। আমার উদ্যোগঃ আমার উদ্যােগের নাম – Farha’s Art । আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরু হয়েছে হ্যান্ডপেইন্টিং দিয়েই। সকল ধরনের পোশাকে পেইন্ট করা ,সাথে আছে হ্যান্ড মেইড গহনা, রুম ডেকোরেশনের জন্য ক্যানভাস ও সুপারি পাতার প্লেট পেইন্টিং। আমার উদ্যোগের নাম Farha’s Art দেওয়ার কারন, আমি ছোট বেলা থেকেই শুনে এসেছি এমনকি দেখে এসেছি মানুষের কর্মেই তার পরিচয়। তাই চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়েই এই উদ্যোগ নেয়া। নিজের একান্ত একটি পরিচয় গড়ে তোলা। নিজস্ব অর্জনে পরিচয় গড়ে তুলে মাথা উঁচু করে বাঁচা। তাই আমারই নাম দিয়েই নিজের উদ্যােগের নামকরণ করেছি। উদ্যোক্তা জীবনের প্রথম অর্ডারঃ প্রথম কাজটি ছিলো আমার একটি হ্যান্ডপেইন্ট কামিজ ও একটি বেবি ফ্রক। আমার উদ্যােগ শুরু হওয়ার পর ৮/১০ দিনের মাথায় এই অর্ডার পাই। যিনি এই অর্ডারটি করেছিলেন তিনি খুব ভরসা করেই আমায় কাজটি করতে দেন। এটাও যেন সেদিন আমার কাছে অনেক বড় একটি প্রাপ্তি ছিলো। প্রথম সেলঃ আমার প্রথম সেল হয় ২০২১ সালের এপ্রিল মাসের ২৮ তারিখ। পন্যটি ছিলো, হ্যান্ডপেইন্ট কামিজ ও বেবি ফ্রক। আর সর্বপ্রথম তার পারিশ্রমিক ছিলো ১০০০ টাকা। আলহামদুলিল্লাহ সেই থেকে ফারহা’স আর্টের যাএা শুরু। আমার উদ্যোগের বৈশিষ্ট্য ও গুনোবলিঃ ১. হ্যান্ডপেইন্টিং পোশাকঃ বর্তমানে রাজত্ব চলছে হ্যান্ডপেইন্টের। একটা সময় কাজ করতেন গুটি কয়েকজন শিল্পী। শাড়ি আর পোশাক নিয়েই কাজ ছিলো তাদের। হ্যান্ডপেইন্টের বিষয়টিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে আড়ং। বিয়ে, গায়ে হুলুদে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মানুষ নিজেদেরকে নতুন ভাবে সাজাতে ব্যস্ত এখন। শাড়ি, পান্জাবী, কামিজ, মাস্ক, টি-শার্ট, কূর্তি, থ্রী – পিস, বিছানার চাদর, শাল, হিজাব, কুশন কভার,পর্দা, বেবি ফ্রক ইত্যাদিতে রং তুলির ছোঁয়া লেগেই আছে। তাই দিন দিন ই বাড়ছে এর মান। ছবিঃ হ্যান্ডপেইন্ট ড্রেস ও মাস্ক ! ২. হ্যান্ড মেইড কাঠের গহনাঃ বাংলাদেশের কাঠের গহনা একটি আলাদা ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের মধ্যে রয়েছে। ফ্যাশন সচেতন নারীদের কাছে কাঠের গহনা এখন পছন্দের তালিকায় প্রথম সারিতে। এ গহনার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো হালকা এবং যে কোনো পোশাকের সাথেই তা ব্যবহার করা যায়। ৩. ক্যানভাস ও সুপারি পাতার প্লেট পেইন্টিংঃ মানুষ প্রতিনিয়তই খুঁজে নতুনত্ব। কিছুটা আধুনিক, কিছুটা ঐতিহ্য। ঘর সাজানোর জন্য খোঁজে শৈল্পিক ছোঁয়া। ওয়াল ডেকোরেশনের জন্য এই সুপারি পাতার প্লেট,ক্যানভাসও অত্যন্ত ইউনিক দেশীয় পন্যের মধ্যে পড়ে। আমার উদ্যোগের বর্তমান চাহিদাঃ বর্তমান বাজারে খাদি ও আড়ং এর হাত ধরেই ভেসে উঠেছে হ্যান্ডপেইন্টের প্লাবন। বাজারে জনপ্রিয় পোশাকগুলোর মধ্যে বর্তমানে একক জায়গায় নিয়েছে হ্যান্ডপেইন্টিং। যাতে আছে শত শত রঙ্গের শৈল্পিক ছোঁয়া। বিয়ে, গায়ে হলুদ, জন্মদিন যা ই বলি না কেন যেকোনো অনুষ্ঠানে পরিধান করছে হ্যান্ডপেইন্ট ড্রেস। আর যদি বলি গহনার কথা তাহলে বলতেই হয় নারী বলতেই শাড়ি আর গহনা। স্টাইলে নতুনত্ব আনতে এখন অনেকেই কাঠের গহনাকে প্রাধন্য দিচ্ছেন। রুম ডেকোরেশনের জন্য মানুষ প্রতিনিয়তই খোঁজে শৈল্পিক ছোঁয়া। রং তুলিতে রাঙ্গানো রংধনু। বর্তমানে আমার উদ্যোগের সবকটিই আলহামদুলিল্লাহ বিপুল চাহিদায় রয়েছে। ভবিষ্যতেও অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ইনশাআল্লাহ। আমার উদ্যোগে যাদের সাপোর্ট পেয়েছিঃ আমার উদ্যোগটা শুরু হয় মহামারী করোনা কালীন। সব ছেড়ে তখন ঘর বন্ধি। পাশে ছিলোনা কেউ। প্রতিটি ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড হতাশাগ্রস্থ্য হয়েছি। পরিবার বলি আর বন্ধু কেউই ছিলো নাহ পাশে। কত মানুষের কাছে ছুটেছি কেউ দেয়নি বিন্দু পরিমান সাপোর্ট। আফসোস মানুষ চিনতে তখন বুজলাম খারাপ সময়টারই প্রয়োজন। কিন্তু আমি নিজেকে থামিয়ে রাখিনি। মহান রাব্বুল আলামিনের অসীম দয়ায় ঠিক সময়ে আমার পাশে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী এনে দেন। হঠাৎ তার সাথে আমার পরিচয় হয়। তার সাথে আমার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই, ছিলো নাহ কিছুই। তবুও সেই মানুষটা মানসিকভাবে এতটা সাপোর্ট দিয়ে গেছে যা আমায় কেউ দিতে পারলো না। কখনো ভুলবোনা তাকে। তার প্রতি আমি চির কৃতজ্ঞ আজীবন। কত কাছের মানুষের কাছে শুনেছি তোকে দিয়ে কিছুই হবেনা আর এগুলোতো হবেইনা। কিন্তু সে মানুষটি কখনো বলেনি তুই পারবিনা কিংবা তোর ধারা সেটা হবে না। সে আমায় যতটা না মানসিক সাপোর্ট করেছে তার সাথে আমার ফারহা’স আর্টের জন্য শারিরীক ভাবেও দিয়েছে শ্রম। প্রতিনিয়তঃ আমাকে ভরসা দিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে তার সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ভাগ্যে হয়তো এটাই ছিলো। কিন্তু তারপরও আমি থেমে থাকিনি ! যখনি হোঁচট খেয়েছি তার বলে যাওয়া কথাগুলো আমায় ভীষণ শক্তি দিয়েছে। সে মানুষটির কাছে আমি ভীষনভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। অতঃপর কাজের স্পৃহা দেখে একটু একটু করে সবার ভালোবাসা অর্জন করি। ছবিঃ ক্যানভাস ও সুপারি পাতার প্লেট ! উদ্যোক্তা জীবনের বাধা-বিপত্তিঃ হ্যান্ডপেইন্টিং উদ্যোগের শুরুতে ভীষণভাবে বুজতে কষ্ট হয়েছিল কাপড় কোনটা কি, কিসের কতটুকু মাপ নিতে হয়। কীভাবে কি করতে হয় জানতাম না কিছুই। ভীষণভাবে হতাশ হই। বার বার মনে হচ্ছিল আমি কি পারবো ! তারপর বিভিন্ন পেইজে গিয়ে অভিজ্ঞ বড় আপুদের কাজের ভিডিও, ছবি দেখে এবং তাদের সাথে প্রতিনিয়ত সময় দিয়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছি, শিখেছি। তাছাড়াও সাহায্য পেয়েছি উইমেন ই-কমার্স, লাকসাম ই-কমার্স, ভিক্টোরিয়া ই- কমার্স এই ই কমার্স সাইটগুলো থেকে। এই সাইটগুলো থেকে নিজের প্রতি যেমন আত্মাবিশ্বাস পেয়েছিলাম ! পেয়েছিলাম কাজের শক্তিও। সেই সাথে পেয়েছি বহু মানুষের ভালোবাসা আর সাপোর্ট আলহামদুলিল্লাহ ! আমার উদ্যোগের প্রাপ্তিঃ ছোট থেকেই রঙ্গের প্রতি একটু বেশিই ভালোবাসা জমে আছে। আমার জার্নির শুরুটা হয় ৫ শত টাকা দিয়ে। তা দিয়ে প্রথম রং,বক্স ও তুলি সেট কিনে আনি। তারপর বাসার ছোট ছোট টুকরো কাপড়ে চেষ্টা চালিয়ে যাই। সেই চেষ্টায় আজ আমি এই পর্যন্ত আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ নিরাশ করেননি আমায়। ৫ শত টাকা দিয়ে শুরু করা উদ্যোগটি আজ আমায় এনে দিয়েছে লাখোপতির কাছে। যদিও আমি খুব বড় উদ্যোক্তা নই। তবুও একজন ক্ষুদে উদ্যােক্তা হিসেবে এটি অনেক বড় প্রাপ্তি। আরো একটি বড় প্রাপ্তির কথা না বল্লেই নয় সেটা হচ্ছে জীবনে প্রথম যখন নিজের পরিশ্রমের টাকা দিয়ে মা-বাবার জন্য উপহার কিনে এনে তাদের সার্প্রাইজ করি সেদিন বাবা-মায়ের মুখের হাসিটি ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। আরো বললে বলতে পারি একজন উদ্যােক্তার কাছে তার বড় প্রাপ্তিটা হলে তার কাস্টমারদের ভালোবাসা ও সম্মান। এই উদ্যােগ নিয়ে যেমন আমি নিজেকে খুঁজতে পেরেছি তেমনি চিনতেও পেরেছি। তেমন করে হাজারো মানুষের প্রতিভা দেখে শিক্ষা গ্রহনও করেছি। পেয়েছি আমি সম্মান ও ভালোবাসা। আমি গর্বিত আমি আমার দেশের একজন ক্ষুদে নারী উদ্যােক্তা হিসেবে। ভবিষ্যত পরিকল্পনাঃ আমার Farha’s Art নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই আরো বহুদূর। এটা আমার শুধু স্বপ্ন নয়, এটি আমার এগিয়ে চলার শক্তি। Farha’s Art চিনার সাথে সাথে চিনবে আমাকেও ! ইনশাআল্লাহ একদিন ক্ষুদ্র থেকে হবে বৃহৎ উদ্যোগ। হ্যান্ডপেইন্টিং নিয়ে Farha’s Art পরিনত হবে একটি ব্র্যান্ডে। লেখকঃ সানজানা ফারহা প্রমি উদ্যোগঃ Farha’s Art