কুকিজ বানিয়ে সফল নারী উদ্যোক্তা মোসাম্মত মাহ্জাবীন !

‘কুকিজ’ বানিয়ে সফল নারী উদ্যোক্তা মোসাম্মত মাহ্জাবীন !
Spread the love

‘কুকিজ’ বানিয়ে সফল নারী উদ্যোক্তা মোসাম্মত মাহ্জাবীন !

‘কুকিজ’ বানিয়ে সফল একজন নারী উদ্যোক্তা মোসাম্মত মাহ্জাবীন ৷ যিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি তৈরি করছেন নানা আইটেমের ‘কুকিজ’ ৷ এই পর্বে আমরা জানবো তার কাছ থেকেই জানবো তার উদ্যোক্তা জীবনের গল্প ৷

নারী উদ্যোক্তা মোসাম্মত মাহ্জাবীনঃ

আমার নাম মোসাম্মত মাহ্জাবীন । আমার জন্ম ঢাকাতেই । ঢাকাতেই বড় হয়েছি, পড়াশোনা করেছি । আমি কম্পিউটারের উপর বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করেছি এবং শিক্ষকতা করছি । পড়াতে আমার খুবই ভালো লাগে। কিন্তু যখন আমার রাজকন্যা এই পৃথিবীতে আসে তখন কিছু শারীরিক প্রবলেমের কারণে আমি চাকরিটা ছেড়ে দেই। তারপর আমি আর চাকরি করিনি। তবে এখনো কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে আইসিটি পড়াই।

নিজে কিছু করার উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণাঃ

মেয়ে যখন ছোট ছিল তখন বাসায় খুব বোরিং ফিল করতাম । কিছু একটা করতে ইচ্ছে করতো। রান্না করতে আমার খুবই ভালো লাগে। তবে প্রতিদিনের নরমাল রান্নাবান্না না, স্পেশাল রান্না। তাই আমি কিছু কোর্স করি এবং বাসায় যখন এগুলো রান্না করতাম তখন সবাই খুব প্রশংসা করতো। বিশেষ করে বাসায় যখন কোন অতিথি আসতো এবং আমার রান্না করা খাবার খেত তখন সবাই বলতো এত মজার খাবার রেস্টুরেন্টও ফেল করবে। আর বলতো তুমি একটা রেস্টুরেন্ট খুলে ফেলো। তখন খুব ইন্সপায়ারড হতাম, ভালো লাগতো। তখন ভাবতাম যদি সত্যি সত্যি একটা রেস্টুরেন্টে খুলতে পারতাম কতইনা ভালো হতো।

আরও পড়ুনঃ একজন সম্ভাবনাময়ী নারী উদ্যোক্তা বাম্পী রায় !

‘কুকিজ’ বানিয়ে সফল নারী উদ্যোক্তা মোসাম্মত মাহ্জাবীন !
ছবিঃ ‘কুকিজ’ বানিয়ে সফল একজন নারী উদ্যোক্তা !

বিশেষ করে আমার কুকিজটা সবাই খুব ই পছন্দ করতো। আমার মেয়েকে বেশির ভাগই বাহিরের দেশের কুকিজ চকলেটসহ বিভিন্ন খাবার কিনে খাওয়াতাম। দেশিয় প্যাকেটজাত খাবারের ওপর ভরসা ছিল না আমার। তারপর যখন নিজে নিজে ‘কুকিজ’ বানানো শুরু করলাম, আমার মেয়ে আমার কুকিজই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতো। আর বাইরের কেউ আসলেতো কোন কথাই নেই। তারপর ধীরে ধীরে মেয়েকে বাইরের খাবার বন্ধ করে আমার তৈরি বিভিন্ন স্পেশাল খাবার খাওয়াতাম। কারণ, সে বাইরের খাবারের চেয়ে আমার হাতের বানানো খাবার ই বেশি পছন্দ করত এবং তা ছিল অনেক পুষ্টিকর।

উদ্যোক্তার পথ বেছে নেওয়ার কারণঃ

করোনা শুরু হওয়ার পর অনলাইন ভিত্তিক কেনাকাটা বেড়ে যায় আমার। এর আগেও করতাম কিন্তু করোনাকালীন সময়ে বেশি করা হতো এবং তখনই উদ্যোক্তাদের গল্প, সফলতার গল্প পড়তাম। তখন ভাবতাম, আমিও তো তাদের মত একজন সফল উদ্যোক্তা হতে পারি। তারপর স্বপ্ন পূরণের সাহস যোগাই। সব চেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছি উই থেকে।
‘কুকিজ’ বানিয়ে সফল নারী উদ্যোক্তা মোসাম্মত মাহ্জাবীন !
ছবিঃ মজাদার হোমমেইড বিস্কুট !

উদ্যোক্তা জীবনের শুরুঃ

আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরু হয় ২০২০ সালের আগস্ট মাসে। আমি কিছু ‘কুকিজ’ বানাই, সেগুলোর অনেকগুলো ছবি তুলি। রাতে একটা ফেইসবুক পেইজ খুলি এবং সেখানে ছবিগুলো পোস্ট করি। সেই দিন ই দুইটা অর্ডার আসে আলহামদুলিল্লাহ। যদিও দুইটাই আমার আত্মীয় করেছিল। তারপরও ভিষণ খুশি লেগেছিল। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে যা যা কিনা লাগবে (বাটার, ময়দা, চিনি, প্যাকেট, বক্স ইত্যাদি ) তা কিনে আনলাম। এরপর ‘কুকিজ’ বানানো শুরু করলাম । ডেলিভারী দিয়ে রিভিউর জন্য অপেক্ষায় রইলাম। আলহামদুলিল্লাহ তারা খেয়ে খুবই প্রশংসা করলো।

আরও পড়ুনঃ একজন নারী উদ্যোক্তা শাম্মী ফেরদৌসী !

এরপর আমার কিছু আত্মীয়-স্বজন, কিছু বন্ধু-বান্ধব, কিছু কলেজের স্যারেরা অর্ডার করলেন। তারপর তাদের রিভিউ থেকে আরো অনেকেই ঢাকা থেকে ঢাকার বাইরে থেকে অর্ডার আসতে লাগল। আর এভাবেই দিন দিন অর্ডারের পরিমান বাড়তে থাকে এবং রিভিউ বাড়তে থাকে। আর আমার স্বপ্নগুলো যেন পাখা মেলতে শুরু করলো। সারা দিন-রাত পরিশ্রম করতে পারতাম। এতটুকু ক্লান্তি লাগতো না আমার। বরং খুবই ভালো লাগতো। এমনও দিন গেছে যে, ভোরে নামাজ পড়ে কাজ শুরু করতাম। শুধু মাঝখানে খাবারটুকু খেতাম আর নামাজ পড়তাম। কাজ করতে করতে রাত বারোটা, একটা, দুইটা বেজে যেত। তারপরও ক্লান্ত হতামনা। অদ্ভুত এক আনন্দ অনুভব করতাম। উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকতাম।

প্রথম প্রথম আমার কোন হেল্পিং হ্যান্ড ছিল না। আমি একাই সবকিছু করতাম। আর আমার হাজব্যান্ড প্যাকিং আর হোম ডেলিভারিতে সাহায্য করতো। তারপর আস্তে আস্তে ডেলিভারি ম্যান এর খোঁজ নিলাম। একটু সুবিধা হলো। তারপর হেল্পিং হ্যান্ড রাখলাম। ধীরে ধীরে পরিসর বাড়তে লাগল। তারপর একসময় চিন্তা করলাম যে, আমার আরও অভিজ্ঞতা অর্জন করা প্রয়োজন। তাই আমি NHTTI তে এক বছরের ডিপ্লোমা-ইন কালিনারি আর্টস এন্ড ক্যাটারিং ম্যানেজমেন্ট এ ভর্তি হলাম ও পাশাপাশি হাইজিন কোর্স করলাম, নন-অ্যালকোহলিক এন্ড বেভারেজ কোর্সও করে ফেললাম। নিজেকে আরও দক্ষ করে গড়ে তুললাম।
‘কুকিজ’ বানিয়ে সফল নারী উদ্যোক্তা মোসাম্মত মাহ্জাবীন !
ছবিঃ মজাদার কুকিজ !

আমার প্রাপ্তিঃ

আলহামদুলিল্লাহ ১ বছর ৬ মাসে আমার অর্ডারের সংখ্যা এখন ১০৩৮। আমি মনে করি, এটা আমার জন্য এক বিশাল ব্যাপার। আর মনে করি, এটা সম্ভব হয়েছে আল্লাহর অশেষ রহমতে, পরিবারের সহযোগিতায়। এছাড়াও আমার দক্ষতা, হাইজিন মেইনটেইন করা পুষ্টিকর, স্বাস্থ্যকর, মজাদার খাবার তৈরি করা হচ্ছে এর আরেকটি কারণ। পূর্বে মাত্র তিন রকমের কুকিজ তৈরি করতাম। এখন প্রায় ১৬ ধরনের কুকিজ এবং ১৫ ধরনের ফ্রোজেন ফুড এবং বিভিন্ন ধরনের ডেজার্ট আইটেম, পিঠা, পাউন্ড কেক, কাপ কেকসহ আরো অনেক ধরনের খাবার তৈরি করি।

আরও পড়ুনঃ কিশোর উদ্যোক্তা রাফি ইসলাম রিশাদ !

আমার এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ’শোর মত কাস্টমার। তার মধ্যে একশোর বেশী রিপিট কাস্টমার। কিছু কিছু কাস্টমার আছেন যারা এই দেড় বছর ধরে আমার থেকে খাবার নিচ্ছেন এবং তারা খুবই সন্তুষ্ট। শুধু তাই নয় ! প্রথমে আমি শুধু ঢাকায় ডেলিভারী দিতাম। তারপর ঢাকার গন্ডি পেরিয়ে ঢাকা ছাড়াও এই পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে আমি প্রায় ১৫টি জেলায় ডেলিভারি দিয়েছি। সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, যশোর, খুলনা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, পিরোজপুর, বরিশাল, নোয়াখালীসহ আরো অনেক জায়গা। এছাড়াও দেশের বাইরে গিয়েছে এই পর্যন্ত ৫ বার। আমি মনে করি এটা আমার জন্য অনেক বড় একটি পাওয়া।

উদ্যোক্তা জীবনের বাধা বিপত্তিঃ

দূর থেকে যখন উদ্যোক্তা জীবনের গল্পগুলো পড়তাম, তখন মনে হতো এটা খুবই মসৃণ একটা পথ। কিন্তু উদ্যোক্তা জীবন যখন শুরু হয় তখন বুঝলাম কতটা কষ্ট করতে হচ্ছে, কতটা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে হচ্ছে, কতটা মানুষের নানান কথা শুনতে হচ্ছে। তারপরও সমস্ত বাধা অতিক্রম করে মানুষের কটু কথাগুলোকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হয়েছে। অনেক সময় মনে হত “যথেষ্ট হয়েছে আর না”। তারপর আবারও ভাবলাম কেন মানুষের কথায় থেমে যাব ! কেন নিজের স্বপ্ন কে গলা টিপে মেরে ফেলবো ! তারপর আবারও শুরু করলাম পথ চলা। পরিবার থেকেও বাধা পেয়েছি, আবার পরিবার থেকেই সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট পেয়েছি। আমার সবচেয়ে বড় সাপোর্টার হচ্ছেন আমার হাজবেন্ড। তাই এখন আর পরিবার বা পরিবারের বাইরের কারো কটাক্ষ বা কটু কথাকে পাত্তা দেই না।

সফল নারী উদ্যোক্তা মোসাম্মত মাহ্জাবীন !
ছবিঃ পাটিসাপটা পিঠা !

আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাঃ

এখন আমি আরো এগিয়ে যেতে চাই। অনেক বড় বড় কাজ করতে চাই। কর্পোরেট কাজগুলোও করতে চাই। আগে হয়তো ১০ জন ২০ জনের খাবার তৈরি করে পাঠাতাম। শেষবার আমি ৮০০ জনের খাবার তৈরি করি। এখন আমি চাই ১০০০, ২০০০, ৩০০০ লোকের খাবার একসাথে তৈরি করতে। তাইতো সেইভাবে নিজেকে গড়ে তুলছি প্রতিনিয়ত। ইনশাআল্লাহ, আমি সততার সাথে এভাবেই এগিয়ে যেতে চাই সবসময়।

আরও পড়ুনঃ একজন সফল কিশোরী উদ্যোক্তা জুম্মা জাফরিন !

৫ বছর পরও আমি চাই আমাকে শুধু এই দেশে নয়, দেশের বাইরেও সবাই আমার Mahjabeen’s kitchen কে চিনবে। এক নামে চিনবে, জানবে এবং এই নামটাই যেন ওদের মাথায় আসে সবসময়। যখনই তারা চিন্তা করবে স্বাস্থ্যকর, পুষ্টিকর মজাদার খাবার তখন ই যেন আমার Mahjabeen’s kitchen এর কথা মনে আসে। তাই সেভাবেই প্রস্তুত করতে চাই আমার উদ্যোগকে। অনলাইন এর পাশাপাশি অফলাইনেও সবার মাঝে পৌছে দিতে চাই আমার এই উদ্যোগকে। যাতে সবাই খুব সহজেই চিনতে পারে। পাশাপাশি আমি কিছু অসহায় মানুষের জন্যও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে যেতে চাই।

লেখকঃ উদ্যোক্তা মোসাম্মত মাহ্জাবীন
উদ্যোগঃ Mahjabeen’s kitchen
Avatar
Jannatun Naime
This is Jannatun Naime. I live in Dhaka, Bangladesh area. My hometown is Chandpur District. I am an Entrepreneur ,Teacher, Blogger and Media Activist. Also a freelancer. These are Graphics Design, Digital Marketing, Video Editing, Content Writing, Content Creator, SEO expert etc with 5 years of experience in the field. I always ‍like to read and write any subject. This website is my personal website. I am a woman who always loves to learn new things and spread it through writing. That’s why I started this blog. The main focus of my writing is to know and write about my country, my district, travel story, freelancing, information and communication technology, science, e-commerce, weaving and crafts, entrepreneurs story, our lifestyle, our cuisine etc. https://jannatunnaime.com
https://jannatunnaime.com/
Top

You cannot copy content of this page