টাঙ্গাইলের তাঁত নিয়ে সফল নারী উদ্যোক্তা প্রিয়াংকা নাগ ! উদ্যোক্তাদের গল্প নারী উদ্যোক্তার গল্প সফল উদ্যোক্তার গল্প by Jannatun Naime - February 18, 2022February 18, 20220 Spread the love টাঙ্গাইলের তাঁত নিয়ে সফল নারী উদ্যোক্তা প্রিয়াংকা নাগ ! টাঙ্গাইলের তাঁত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, টাঙ্গাইল তাঁতের গোড়াপত্তন করেন সিন্ধু অববাহিকা থেকে আসা বসাক সম্প্রদায়ের লোকেরা। তারপর ধীরে ধীরে এই তাঁতের তৈরিকৃত পোশাক ছড়িয়ে পড়েছে সকলের মাঝে এবং উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছেন নারী উদ্যোক্তারা। তার মধ্যে প্রিয়াংকা নাগ অন্যতম। এই পর্বে আমরা জানবো তার টাঙ্গাইলের তাঁত নিয়ে এগিয়ে চলার গল্প। নারী উদ্যোক্তা প্রিয়াংকা নাগঃ আদাব। আমি প্রিয়াংকা নাগ। আমার জন্মস্থান নরসিংদী জেলার মাধবদীতে। আমি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আমরা দুই ভাই, এক বোন। আমার বেড়ে উঠা মাধবদীতেই। আমি মাধবদী গালর্স স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি পাশ করি। এইচ.এস.সি পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই আমার বিয়ে হয়ে যায় নরসিংদী জেলার শিবপুর। সেখানে শিবপুর শহীদ আসাদ কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে আমি অনার্স এবং মাস্টার্স পাশ করি। নিজে কিছু করার উৎসাহঃ ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিলো নিজে কিছু করার এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। তবে একটা সময় সেই স্বপ্ন বিলীন হয়ে গিয়েছিল। স্বামীর চাকরির সুবাদে ঢাকায় চলে আসতে হয়। তারপর ঘর, সংসার, বাচ্চা এগুলো নিয়েই কাটতে থাকে সময়। তবে মনের কোনে সবসময় একটা ইচ্ছে ছিলো “যদি কিছু করতে পারতাম”। সেই মাধ্যম টাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ▶ আরও পড়ুনঃ কুকিজ বানিয়ে সফল নারী উদ্যোক্তা মোসাম্মত মাহ্জাবীন ! ছবিঃ টাঙ্গাইলের শাড়ি ! ২০১৯ সালের মার্চ মাস থেকে পুরো পৃথিবী যখন থমকে গিয়েছিল তখন আমরাও ঢাকা থেকে গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। তখন ঘরের কাজের পর সময় কাটানোর জন্য ফেইসবুক ছিল একমাত্র মাধ্যম। সেই সময়টাতে একদিন চোখ পড়ে শ্রদ্ধেও রাজিব আহমেদ স্যারের লেখা। স্যারের লেখাগুলো ছিল খুবই অনুপ্রেরণামূলক। রাজিব স্যারের মাধ্যমে সন্ধান পাই ‘উই’ নামক প্ল্যাটফর্মের এবং আমার বিলীন হয়ে যাওয়া স্বপ্নটা আবারও জেগে উঠে। উদ্যোক্তা জীবনের পথচলাঃ উই-তে যখন সময় দেয়া শুরু করি তখন দেখতে পেলাম সেখানে আমার মতো অসংখ্য নারীরা আছেন। যারা নিজে কিছু করতে চায় এবং সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায়। তখন আর দ্বিতীয়বার চিন্তা না করে আমিও আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরু করার চিন্তা করি। আমার মামার বাড়ি টাঙ্গাইল হওয়ার সুবাদে আমি টাঙ্গাইলের তাঁত পন্য টাঙ্গাইল শাড়ি এবং নরসিংদীর বাটিক শাড়ি নিয়ে কাজ করবো বলে ঠিক করি। ▶ আরও পড়ুনঃ যশোরের নকশি পোশাক নিয়ে উদ্যোক্তা নাদিরা রিয়ার গল্প ! তারপর আমার উদ্যোক্তা হওয়ার কথা সর্বপ্রথম আমি আমার স্বামীকে জানাই এবং তার শতভাগ সাপোর্টও পাই। এতে করে আমার মনের জোর আরও বেড়ে যায়।তখন আমি আমার ছোট ভাইকে নিয়ে খুবই স্বল্প পরিসরে কিছু টাঙ্গাইল শাড়ি এবং বাটিক শাড়ি নিয়ে শুরু করি আমার উদ্যোক্তা জীবন। যেহেতু আমি অনলাইন উদ্যোক্তা তাই সবার প্রথম আমি একটি পেইজ খোলার চিন্তা করি এবং পেইজের নাম দেই Rajonya-রাজন্যা। রাজন্যা আমার মেয়ের নাম। মেয়ের নামেই আমি আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরু করার চিন্তা করি। উদ্যোক্তা জীবনের প্রথম সেলঃ তখন ঘরের কাজের পাশাপাশি পুরো সময়টা দিয়েছি উইয়ে। কিভাবে নিজের পরিচিতি বাড়ানো যায় এবং নিজেকে ও পন্যকে কিভাবে সবার সামনে তুলে ধরা যায় সেই চেষ্টা করেছি। উইয়ের পাশাপাশি আমি সন্ধান পাই ডিজিটাল স্কিলস ফর বাংলাদেশ নামক গ্রুপের। এই গ্রুপটি আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। কিভাবে নিজের জড়তা কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায় তার মুলমন্ত্র শিখিয়েছে। আমি তখন অনেক লিখতাম নিজের পন্য নিয়ে এবং বিভিন্ন টপিক নিয়ে। ▶ আরও পড়ুনঃ সারথী নিয়ে উদ্যোক্তা রুমানা আক্তারের সফলতার গল্প ! উই তে যখন লেখা শুরু করি তখন আমার স্কুলের এক বান্ধবী জানতে পারে আমার উদ্যোক্তা হওয়ার কথা। তখন সেই বান্ধবী আমার প্রথম কাস্টমার হয়। সেই দিনটি আসলে আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। যদিও সে আমার বান্ধবী ছিলো। তবে তার সাথে আমার অনেক বছর যাবত কোন যোগাযোগ ছিলো না। উইতে সে আমাকে এবং আমার পন্য দেখে প্রথম কাস্টমার হয়। সেইদিন মনে হয়েছিলো যে আমি পারবো। তারপর আমি আমার কাজে আরও মনযোগী হওয়া শুরু করলাম। ছবিঃ টাঙ্গাইলের শাড়ি ! তাঁত পণ্য নিয়ে কাজ করার কারণঃ ছোটবেলায় মামার বাড়ি গেলে সেখানে তাঁতিদের কাজ করা দেখতাম। তাঁতের কলে তৈরি তাঁতের শাড়ি, তানায় সুতা পেছানো এগুলো আমার খুব ভালো লাগতো।আমার মামারা যেহেতু এই পেশার সাথে জড়িত তাই বাড়িতে থাকতো নানা কালারের সুতা,হরেক রকমের শাড়ি। সেগুলো দেখে শাড়ির প্রতি একটা দুর্বলতা কাজ করতো সবসময়ই। আর নরসিংদীর বাবুরহাট কাপড়ের জন্য বিখ্যাত। এটা সারা বাংলাদেশ ই জানে। বাবুরহাটের কাপড় যায় সারা বাংলাদেশে। সবদিক থেকেই তাঁতের প্রতি ভালোবাসাটা ছিলো সবসময়। তাঁতের বিশেষত্বঃ তাঁত বাংলাদেশের একটা বিশেষ জায়গা নিয়ে আছে। টাঙ্গাইল তাঁত অনেক প্রাচীন এবং সেই প্রাচীনকাল থেকে এতটাই প্রশংসনীয় যে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতাও তার ভ্রমণ কাহিনীতে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির গল্প বলেছেন। টাঙ্গাইল শাড়ির বিশেষত্ব হল এর পাড় এবং পাড়ের নকশা। তাঁতের শাড়ির বৈচিত্র্য নির্ভর করে অনেকটা এর পাড়ের ওপর। শাড়ির পাড় যত সুন্দর হয় তত শাড়ির সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। টাঙ্গাইল শাড়ির পাড়গুলোর বিভিন্ন নাম রয়েছে। যেমন – পদ্মপাড়, সরবী, তেরবী, কুঞ্জলতা, শিকল পাড়,মাধবীলতা ইত্যাদি। বাধা বিপত্তির শিকারঃ উদ্যোক্তা জীবনের শুরুটা যদিও সহজ ছিলো না। তবুও আমার পরিবার থেকে কখনো আমাকে আমার উদ্যোক্তা জীবন নিয়ে কোন কথা বলেনি। কিন্তু বাইরের মানুষের কাছ থেকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে আমাকে। অনেকেই আমার পরিবারকে বলেছে আমি কেন এই পেশায় আসলাম। তবুও আমি থেমে থাকিনি। আর আমার পরিবারও কখনো আমাকে বাধা দেয়নি। তারা এখনো আমাকে সবসময় সাপোর্ট করে চলেছে। ছবিঃ টাঙ্গাইলের শাড়ি ! আমার অর্জনঃ উদ্যোক্তা জীবন শুরুর পর থেকেই দেখছি উইতে লাখপতি হওয়ার গল্প। আমিও সেই লাখপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। আমার পেইজ খোলার পর আমার কাছের মানুষ এবং আমার সহপাঠীরা আমাকে অনেক সাহায্য করে এবং সামনে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করে। পাশাপাশি আমার ছোট ভাইয়ের বন্ধুরাও এগিয়ে আসে এবং চার মাসে আমি আমার পেইজ থেকে প্রথম লাখোপতি হই এবং উই থেকে সাত মাসে লাখোপতি হই। তখন থেকে এখন পর্যন্ত আমার অর্জন বলতে আমি ছোট পরিসরে হলেও আমার একটা নিজের পরিচিতি তৈরি করতে পেরেছি এবং অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়ে যাচ্ছি। সবকিছু আসলে টাকা দিয়ে অর্জন করা যায় না। আমি মনে করি উদ্যোক্তা জীবনে না আসলে আমার এই অর্জন কখনোই সম্ভব হতো না। ▶ আরও পড়ুনঃ মসলা নিয়ে এগিয়ে চলছেন সফল উদ্যোক্তা শারলিনা আলম ! ভবিষ্যত পরিকল্পনাঃ ভবিষ্যতে আমি আমার এই উদ্যোক্তা জীবনের মাধ্যমে ভালো কিছু করতে চাই। আমি চাই আমার এই দেশীয় পন্যগুলো যেন শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের বাইরেও এর প্রসার লাভ করাতে পারি। পাশাপাশি নিজের উন্নয়নের পাশাপাশি আমি চাই যেসকল মানুষ দিন-রাত এক করে আমাদের জন্য দেশীয় পণ্যগুলো তৈরি করে যাচ্ছে তাদের জন্য কিছু করার। তাদের নিখুঁত হাতে যদি শাড়িগুলো না তৈরি হতো তাহলে আমাদেরও উদ্যোক্তা জীবনে কিছু করা সম্ভব হতো না। সবশেষে, শুধু একটি কথাই বলবো “আমরা নারী,আমরাই পারি। তাই আমাদের থেমে থাকলে কখনো চলবে না”। লেখকঃ প্রিয়াংকা নাগ উদ্যোগঃ Rajonya-রাজন্যা