যশোরের নকশি পোশাক নিয়ে উদ্যোক্তা নাদিরা রিয়ার গল্প ! উদ্যোক্তাদের গল্প নারী উদ্যোক্তার গল্প সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তার গল্প by Jannatun Naime - February 17, 2022February 17, 20220 Spread the love যশোরের নকশি পোশাক নিয়ে উদ্যোক্তা নাদিরা রিয়ার গল্প ! যশোরের নকশি পোশাক মানে ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন। এই পোশাকগুলো দেখতে যেমন সুন্দর হয় তেমনি পরতেও অনেক আরাম। তাইতো বাঙ্গালী ললনাদের কাছে এর কদর কোন অংশেই কম নয়। আর সেই ঐতিহ্যবাহী পোশাক নিয়ে কাজ করছেন উদ্যোক্তা নাদিরা রিয়া। এই পর্বে আমরা জানবো যশোরের নকশি পোশাক নিয়ে তার এগিয়ে চলার গল্প। উদ্যোক্তা নাদিরা রিয়াঃ আমি নাদিরা রিয়া। জন্মসূত্রে মাগুরার মেয়ে। বেড়ে উঠা গ্রামেই। ইংরেজিতে অনার্স শেষ বর্ষে থাকতেই বিয়ে হয়ে যায়। তারপর মাস্টার্স শেষ করে হয়ে যাই এক পুত্রের জননী। এরপর একে একে বেশ কয়েকটা চাকরির পরীক্ষা দিতে থাকি। কিন্তু বাচ্চা আর সংসারের চাপে পড়াশোনা টা ঠিকমত না করায় খুব বেশি ভালো করতে পারি নি। ব্যাস, সন্তানকে শ্রেষ্ঠ সময়টা দেয়ার জন্য পাল্টে ফেললাম নিজের লক্ষ্য। কাজ শুরু করলাম হাতের কাজের পোশাক নিয়ে। আর সেটা সেলাই করে আমার আপা। তবে তার ছিল না কোন মোবাইল। তাই ব্র্যান্ডিং এর দায়িত্বটা আমিই নিয়ে নিলাম। এরপর একে একে যুক্ত করেছি অনেক কিছু এবং সবটাই নিজের হাতে তৈরি করি। ▶ আরও পড়ুনঃ কেক ও ডেজার্ট নিয়ে উদ্যোক্তা আফিয়া ও তানিয়ার গল্প ! বিসিএস এর স্বপ্ন ছেড়ে বাচ্চা আর সংসার সামলে নিজে কিছু করার অদম্য ইচ্ছা থেকে হয়ে গেলাম উদ্যোক্তা। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম নিজের একটা ভালো অবস্থান তৈরী করার। তাই সেভাবেই পড়াশোনাটা মন দিয়ে করতাম। স্কুল জীবনের সকল পরীক্ষায় হয়েছি প্রথম। সেখান থেকেই স্বপ্ন বোনা শুরু। কিন্তু সংসারে এসে শুধু সংসারের মায়ায় জড়িয়ে গিয়ে সারাজীবন ধরে দেখা স্বপ্ন কে এক মুহুর্তে বদলে ফেলে শুরু করলাম নতুন করে উদ্যোক্তা হওয়ার পড়াশোনা। ২০২০ এর ডিসেম্বর থেকে উদ্যোগ শুরু করলেও, অনলাইনে সেল শুরু হলো এফ্রিলের ২০২১ সাল থেকে। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। এগিয়ে চলেছি আপন মনে। নিজের হাতের তৈরি গহনা, হ্যান্ডপেইন্টের পোশাক, আর আমার ফোকাসড পন্য যশোরের নকশি পোশাক যেমন- শাড়ী, পান্জাবী, থ্রি-পিস, টুপিস, ওয়ান পিস, ব্লাউজ পিস আর শাল। ছবিঃ হ্যান্ডপেইন্ট পাঞ্জাবী ! উদ্যোক্তা জীবনের পথচলাঃ আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরু হয় মাত্র ৫০০ টাকা দিয়ে। ২০২০ সালে যখন উদ্যোগ শুরু করেছিলাম, বলতে গেলে আমার হাজবেন্ড ছাড়া আর কারও তেমন সায় পাই নি। আমার বাবা মায়ের তো না ই। তারা তো চেয়েছেন সবসময় আমি যেন অন্ততঃ একটা জব করি। কিন্তু আমি যখন সব চেষ্টা বাদ দিয়ে অন্য রাস্তায় হাঁটা শুরু করি সেটা তাদের একদমই পছন্দের ছিলো না। আমার বন্ধু-বান্ধবীদের একে একে সবার চাকরি হবার খবরে তারা আরও বেশি মনে মনে আহত হতেন। শুধুমাত্র আমার হাজবেন্ড আমার সাপোর্টে ছিল সবসময়। ▶ আরও পড়ুনঃ একজন সম্ভাবনাময়ী নারী উদ্যোক্তা বাম্পী রায় ! তাই যখন হাতের কাজের পন্য নিয়ে এগোতে চাইলাম, তখন সে আমাকে কিছু টাকা দিলো এবং সেটা আমি আপুকে দিয়ে প্রথম কাজ শুরু করলাম। যুক্ত হয়ে গেলাম বিভিন্ন ফেইসবুক গ্রুপে শুধু পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং এর উদ্দেশ্যে। নিজেই খুললাম পেইজ। নাম দিলাম Heaven। প্রথম চার মাস এক টাকাও সেল হয় নি। কিন্তু নিয়মিত লেগে থেকেছি উই তে। হঠাৎ একদিন নিজে থেকেই এই গ্রুপে জয়েন হয়ে যাই। সবার সাফল্যের গল্প শুনে আমারও খুব আশা জাগতো। তবে সেল হয়নি তখনও। প্রথম সেলঃ উই-তে থেকেছি একটানা। এরপর ২০২১ এর জানুয়ারি তে পেলাম ডিএসবির খোঁজ। সেখানে দেখলাম জ্ঞানের মহাসমুদ্র। আমি শিখতে লাগলাম কোনপথে আমাকে হাঁটতে হবে। যেহেতু আমি কাস্টমাইজড ডিজাইন সম্পুর্ণ হাতে এঁকে সেলাই করি, তাই আস্তে আস্তে এর চাহিদা বাড়তে শুরু করলো। এফ্রিলের পর আর পেছনে তাকাতে হয় নি। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাত্র ৫০০ টাকা দিয়ে কিনলাম তিনটা ব্রাশ আর ৫ টা রং। এরপর শুধু শখের বসে প্রথমবার পেইন্ট করলাম ছেলের পান্জাবীতে। এরপর কাঠের তৈরি গয়না পেইন্ট করলাম। ▶ আরও পড়ুনঃ একজন সফল কিশোরী উদ্যোক্তা জুম্মা জাফরিন ! একদিন বিকেলে পার্সোনাল প্রোফাইলে পোস্ট দেওয়ার সাথে সাথে আমার আটটি কাঠ গয়না সেল হয়ে যায়। ব্যাস, ব্যস্ত হয়ে গেলাম এবার নতুন করে। এরপর একে একে করেছি হ্যান্ডপেইন্টের পান্জাবী, মাস্ক আর কুর্তি। যেগুলো এখনও আমি নিজের হাতেই করি এবং এগুলোর প্রচুর অর্ডার পাই। এরপর বানালাম মেটাল আর পার্লের গয়না। যা এখনো পর্যন্ত আমার বেস্ট সেলিং। উইতে একটা পার্ল নেকলেসের এক ছবিতেই অর্ডার পড়লো ২৩ টা এবং সেই একই গয়নার আরও একটি ছবি পোস্ট করলাম Her E Trade নামক আরেকটি ফেইসবুক গ্রুপে। সেখান থেকে আসলো ৩০ টার উপরে অর্ডার, তাও একদিনেই। ছবিঃ গহনা ! স্বপ্ন যখন লাখ টাকার সেলঃ উইতে যখন অনেকের পোস্ট দেখতাম তারা এক লক্ষ টাকা সেলের মাইলফলক ছুঁয়েছেন, খুব শখ হতো একদিন আমিও লাখপতি হবো। খুব স্বপ্ন দেখতাম। এফ্রিলে সেল শুরু হয়ে অক্টোবর ২০২১ এসে শুধু হাতের কাজের ড্রেস সেল করেই ছুঁইয়ে ফেললাম সেই স্বপ্নের মাইলফলক। এরপর ২০২২ এর ফেব্রুয়ারিতে গয়না দিয়ে আরও এক লাখ টাকা সেলের টার্গেট পূর্ণ হলো আলহামদুলিল্লাহ। উদ্যোগ নিয়ে আমার স্বপ্নঃ একটা সময় আমার আপু একাই সব করতো। এখন আলহামদুলিল্লাহ আমার সাত জন কর্মীর পরিবার জড়িত আমার উদ্যোগের সাথে। তবে এখনও অনেকটা পথ বাকি। কারণ, এখন আমি সব কাজ একাই করি। তবে আমার স্বপ্ন আছে, আমি একটা ছোট্ট স্টুডিও করবো শুধু আমার প্রডাক্ট ফটোগ্রাফির জন্য। নিজে তো পন্যের মডেল হতে পারবো না। তবে ইচ্ছে আছে, আমার কর্মীদেরকেই বানাবো আমার পন্যের মডেল। ▶ আরও পড়ুনঃ একজন নারী উদ্যোক্তা শাম্মী ফেরদৌসী ! এছাড়াও, যেহেতু আমি সমস্ত ডিজাইন করি কাস্টমাইজড এবং সেটা এখনও নিজেই ড্রয়িং করি। তবে ইচ্ছে আছে কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী ইচ্ছে মত ডিজাইন করার জন্য কোনও একদিন আমারও থাকবে নিজস্ব ডিজাইনার। তবে আমি অফলাইনে বুটিক শপও করবো ইনশাআল্লাহ। সেটা শুধুই আমার বানানো সব পন্যের প্রদর্শনী কেন্দ্র হিসেবে। উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনের গল্পঃ স্কুল জীবন শেষ করি গ্রামেই। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়ে তখনই মোটামুটি ভালো ছাত্রীর পরিচিতি পেয়ে যাই গোটা এলাকায়। এরপর স্কুলজীবনের কোনও পরীক্ষায় ২য় হইনি। এসএসসির পরে এইচএসসিতে ভর্তি হই রংপুরে। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি আর এইচএসসি পাশ করে ভর্তি হই ইংরেজিতে অনার্সে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স শেষ করে হয়ে যাই পুরোদস্তুর সংসারী। এর পাশাপাশি চেষ্টা করে চলি খুব স্বাভাবিক নিয়মেই একজন গ্রাজুয়েট যে চাকরির চেষ্টা করে, আমিও সেটাই করি। ▶ আরও পড়ুনঃ হ্যান্ডপেইন্ট নিয়ে উদ্যোক্তা মিথিলা ফারহানা মীমের গল্প ! কিন্তু একেতো ছেলেটা খুব ছোট তারপর আবার সংসারের বাড়তি চাপ। এসব সামলে খুব বেশি সময় পড়াশোনাটা করা হয়ে উঠতো না। ফলে চার-পাঁচটা চাকরির পরীক্ষায় ব্যর্থ হই। কিন্তু তবুও হেরে যাই নি। শুধুমাত্র হাজবেন্ড এর সহায়তায় স্বপ্ন দেখতে শুরু করি ঘুরে দাঁড়ানোর। আর টানা এক বছর দুই মাস পরে আমি এখন একজন উদ্যোক্তা। খুব খুশি হই আবার অনেক গর্বও হয় যখন দেখি আমার হাতে তৈরি পন্য পেয়ে কাস্টমাররা ভীষণ খুশি হন। ছবিঃ গহনা ! আমার একান্ত চাওয়াঃ আমি খুব চাই আমার সন্তান গর্ব করে বলুক, আমার ‘মা’ একজন উদ্যোক্তা। এখন আমার বাবা-মাও আমাকে সাপোর্ট দেন পুরোটাই। আমার বাবা বলেন, “যে একবছরে শূন্য হাতে শুরু করে এত পরিশ্রম করে তার উদ্যোগের একটা কাঠামো তৈরি করে ফেলেছে, সে আর হারবে না”। আমার সব স্বপ্নের পেছনে থেকে আমাকে যে সাহস দিয়ে গেছে সে আমার আপা। আমার খুব ইচ্ছে তার জন্য আমি অন্তত কিছু একটা করতে চাই। যা তার একান্ত নিজের হোক। আমার প্রাপ্তিঃ আমি নিজে চাকরি করতে পারিনি পরিবারের জন্য, কিন্তু এখন আমার আর কোনও আক্ষেপ বা কষ্ট কিছুই নেই। কারণ, আমি পেরেছি কিছু মানুষের ভরসা হতে। আমি আমার বাচ্চাটাকে পুরোটা সময় দিতে পারি। যেটা জব করলে সম্ভব হতো না। আমার কাজের কৈফিয়ত দিতে হয় না কাউকে। মন চাইলেই করতে পারি। কারও অধীনস্থ হয়ে কাজ করতে হয় না। আর সব থেকে বড় পাওয়া, আমার জন্য কিছু পরিবার এই করোনাকালীন সময়েও তাদের উপার্জন বন্ধ করতে হয় নি। তাদের এতটুকু অবলম্বন হতে পেরে সত্যিই ভীষণ ভালো লাগে। লেখকঃ নাদিরা রিয়া উদ্যোগঃ Heaven