সৃজনশীল নারী উদ্যোক্তা নাহিমা খন্দকার তরু উদ্যোক্তাদের গল্প সৃজনশীল উদ্যোক্তার গল্প by Jannatun Naime - October 1, 2021October 1, 20210 Spread the love সৃজনশীল নারী উদ্যোক্তা নাহিমা খন্দকার তরু একজন সৃজনশীল নারী উদ্যোক্তা নাহিমা খন্দকার তরু । যিনি তার সৃজনশীল মেধা আর উদ্যোগ নিয়ে তৈরি করেছেন Almonda নামক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও Almonda Training Center. এই পর্বে আমরা তার মাধ্য়মে জানতে পারবো কিভাবে তিনি সৃজনশীল উদ্যোগ শুরু করেছেন এবং কতদূর এগিয়েছেন ! চলুন জেনে নেওয়া যাক একজন সৃজনশীল নারী উদ্যোক্তা নাহিমা খন্দকার তরুর সৃজনশীল নারী উদ্যোক্তা জীবনের গল্প । নাহিমা খন্দকার তরুর গল্পঃ “জীবন যেখানে যেমন” ! আমি নাহিমা খন্দকার তরু। এটাই আমার একমাত্র পরিচয় বলে আমি মনে করি। আমি ঢাকা বিভাগের শরীয়তপুর জেলার এক মুসলিম পরিবারের মেয়ে । বাবা-মায়ের ২য় সন্তান আমি । একমাত্র বড় বোন চাকরি, সমাজ, সংসার নিয়ে ভালো অবস্থানেই অবস্থান করছেন ! আমার নিজেকে কোন একটা অবস্থানে দাঁড় করাতে হবে তা বোঝার আগে অজান্তেই ডুবে গিয়েছিলাম সৃজনশীলতার চর্চায়। সে অনেক আগের কথা । ছাত্রী হিসেবে মোটামুটি ভালোই ছিলাম । ভালো বলার কারন হলো, ক্লাস ওয়ান থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত কেহই পারেনি আমার অবস্থান ওয়ান থেকে দ্বিতীয়তে নামাতে। ইংরেজি হাতের লিখাটাও ছিল বেশ হিংসে করার মত ! কোন একদিন মধ্য দুপুরে ক্লাস রুমে শিক্ষকের পড়া কান অবধি পৌঁছানোর আগেই ফিকে হয়ে যাচ্ছিল, কারন আমার দৃষ্টি ছিল শিক্ষকের মুখ অবয়ের দিকে । আর যখন দৃষ্টি চৈতন্য ফিরে পেলাম, দেখলাম নিজের নোট খাতায় কলমে আঁকা শিক্ষকের মুখমন্ডল । ছবিঃ নাহিমা খন্দকার তরু শুরুটা বোধকরি এভাবেই হয়েছিল ! বাসায় খাতায়ও একদিন এঁকে ফেললাম বাবার রেখে যাওয়া ফোরআর সাইজের ফটোর হুবহু কপি । বাবার রেখে যাওয়া বলতে, কর্মসূত্রে বাবা দেশের বাইরে অবস্থান করতেন উকিল হওয়া সত্বেও। আমার বয়স যখন ছয়, তখন থেকেই তিনি দেশের বাইরে থাকতেন । এভাবেই সবকিছু চলতে লাগল । একদিন বাসায় বেড়াতে এলো বাবার মামাতো বোন, সাথে তার ননদ । মানে আবহাওয়া পরিবর্তন যাকে বলে। কিন্তু তার হাতে দেখি কিছু একটা জিনিস, যার মাধ্যমে ( সুতা আর লম্বা সুইয়ের মাধ্যমে ) সে কিছু একটা রুপদানে মত্ত ছিল । মা-কে বলতেই মা বলল, এটাকে বলে ক্রুশের কাজ ,আমারও আছে । আমি বললাম, আমিও শিখব ! আমার মা বলল বয়স হোক সব শিখতে পারবে (আমার মা চমৎকার হাতের কাজ জানতেন)। একদিন দেখি মা সেই কুশিকাটার সুঁই আর সূতার যুগলবন্দী ঘটাচ্ছেন তার ব্লাউজের হাতায়। পাশে বসে তার কাছ থেকে শিখে নিলাম । মায়ের সেই সুঁই এখন ও আমার কাছে আছে । এভাবে আরও একবার মেতে উঠলাম সৃজনশীলতার চর্চায় । একাকিত্ব, বিষন্নতা, ভালোলাগা, দুঃখ-কষ্ট, প্রাপ্তির উচ্ছলতা সব কিছুতেই শিল্পচর্চার প্রাধান্য বাড়িয়ে দিলাম । কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগতো ! এভাবেই চলতে লাগলো পড়াশোনা আর ভালোলাগার কাজ । ১৯৯৯ সালের কথা ! তখন সব কিছু এত সহজে পাওয়া যেত না । সবে তখন কলেজে ভর্তি হয়েছি । মোহাম্মদপুরে থাকতাম তাই আড়ং ছিল আমাদের বেষ্ট একটা শপিং মল। ধানমন্ডিতে বুনন নামে একটা দোকানে প্রথম ব্লক এর থ্রি পিস দেখেছিলাম । অনেক দাম । তবে ১৫০০টাকা দিয়ে অন্য একটা দোকান থেকে কিনে উপহার হিসেবে দিলাম আমার একমাত্র খালাতো বোনকে । মাথায় ঘুরতে থাকে কোথায় থেকে এই কাজ শিখা যায় । অনেক কষ্টে একজনের কাছে সামান্য কেনা রং দিয়ে কিভাবে করা যায় তা শিখে নিজের জন্য একটা জামা তৈরি করে নিলাম । শুরু করলাম খোঁজ করা । এমন প্রতিষ্ঠান যেখান থেকে ব্লকের পুরো কোর্স করতে পারি খোঁজ পেয়ে কোর্সটাও করে নিলাম । সাথে আরো অনেক কিছু এই যেমন ব্লক, বাটিক, টাইডাই, কারচুপি, বেকারি, জামা কাপড় কাটিং ইত্যাদি । এর ই মাঝে স্নাতক ডিগ্রী শেষে শুরুও করলাম বুটিক এর কাজ কয়েক জন বন্ধু মিলে। ভালোই চলছিল ! বিপত্তি ঘটাল সমাজ ব্যবস্থা । শেষমেশ কিনা মেয়ে জামা কাপড় বিক্রি করবে ? তারপর ব্যবসা বন্ধ করে চালু রাখলাম প্রশিক্ষণ পর্ব । কত্ত কষ্ট করে নিজে কাজগুলো শিখেছি এবং অন্যকেও শেখাতাম তা আমি নিজেই জানি । শুধুমাত্র মা সাপোর্ট করতো বলে পেরেছি । আমার শেখার জন্য টাকা মা আর কত দিবে ! তাই নিজে টিউশনি করতাম । তা দিয়ে নিজের পছন্দমত কাজগুলো করতাম । তারপর থেকে এই হাতটাকে আমি এতোটাই ভালোবাসি যে, রাত দিন পরে থাকতে পারি তা নিয়ে । ছবিঃ নাহিমা খন্দকার তরু পড়াশোনা, কাজ, পাশাপাশি ছোট একটা চাকরি একসাথে করতে হিমশিম খেতে হত । তারপরও আমার ভাললাগার কাজ ছাড়িনি । এম বি এ (মার্কেটিং) শেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছি বেশ সফলতার সাথে । কিন্তুু কিছু একটার অভাব বোধ করতাম । কাজ কিন্তু থেমে নেই । এর ই মাঝে জীবন সংসারে জড়িয়ে পড়লাম । জীবনসঙ্গী হিসেবে যাকে পেলাম সে এক চমৎকার লোক ই বটে বলতে হয় । কারন তার কোন কিছুতেই না নেই । তার মাঝে সরকারি, বেসরকারি এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে আরো কিছু হস্ত শিল্পের উপর অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করতে লাগলাম। অংকের হিসেবে গণনা করলে ২০০ থেকে ২৫০ টার মত বিষয়ে কাজ করি । একদিন বাসার কর্তাকে বললাম, এই নয়টা পাঁচটা অফিস আর করব না । আমি আমার নিজের কাজ করব। সে মাল্টি ন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা । সে বলল, ঠিক আছে করো । কিন্তু যৌথ পরিবারে নিজের মত কাজ করা এতোটা সহজ ছিল না ! তার উপর বাড়ির বড় বউ আমি । অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে । এমনও কথা শুনতে হয়েছে, “এম বি এ পাস করে শেষে হাতের কাজ?” শ্বশুর মশাই আর শ্বাশুড়ি মা সাপোর্ট করার কারনে করতে পেরেছি । তারা বলতো, বাড়ির বউকে তো আর বাইরে যেতে হচ্ছে না ! তাহলে সমস্যা কোথায় ? তার-ই দেয়া Almonda Training Center নামে একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করে কাজ করতে লাগলাম । এই হল আমার নিজের জায়গা ! যেখানে আমি আমার মত করে কিছু করতে পারছি । যখন কেউ আমার কাছ থেকে কাজ শিখে নিজে কিছু করছে জানতে পারি, তখন নিজের কাছেই নিজেকে গর্বিত মনে হত । এর-ই ধারাবাহিকতায় আজ আমার একটা পেইজ, একটা গ্রুপ, একটা শেখানোর জায়গা তেরি হয়েছে । যা আমি নিজের হাতে পরিচালিত করতে পারছি । এগুলো হলো, ভারচ্যুয়াল জগতে নিজেকে উপস্থাপন করার অন্যতম মাধ্যম ।.আমি হয়তো অন্যদের মত কাড়ি কাড়ি টাকা কামাচ্ছি না । কিন্তু আমি আমার সৃষ্টিতে তৃপ্ত, সার্থক, নিজেকে নিয়ে গর্বিত । এখনও নতুন কিছু পেলে শিখতে বসে যাই । বয়স আমাকে আটকাতে পারেনি সেই সৃষ্টিশীল কাজ থেকে ! এখনও নিয়ম করে রোজ বিকেলে কাজ শিখতে আসা সৃজনশীল মানুষের মাঝে হারিয়ে যাই । প্রতিদিন নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করি কাজের মাধ্যমে। এতেই আমি আত্মতৃপ্তি পাই । ছেলে, ছেলের বাবা আর আমি কখনো হিসেব করিনা না পাওয়াকে । বরং প্রাপ্তির খাতা নিয়ে বসি আর স্মৃতিচারন করি । আসলে আমরা অল্পতেই খুশি । কাকে কি দিলাম বা আমার দ্বারা আরো কিছু দেয়া সম্ভব হয় কিনা তা নিয়ে ভাবতে বসি । এইতো, বেস ভালো আছি । সকাল শুরু হয় গানের মাধমে । সারাদিন চলে যায় সৃষ্টিশীল কাজের পেছনে । আবার রাত্রিকে বরন করি গানের মাধমে। লেখকঃ নাহিমা খন্দকার তরু উদ্যোগঃ Almonda