হ্যান্ডপেইন্ট নিয়ে উদ্যোক্তা মিথিলা ফারহানা মীমের গল্প ! উদ্যোক্তাদের গল্প সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তার গল্প by Jannatun Naime - February 15, 2022February 15, 20220 Spread the love হ্যান্ডপেইন্ট নিয়ে উদ্যোক্তা মিথিলা ফারহানা মীমের গল্প ! একজন সম্ভাবনাময়ী নারী উদ্যোক্তা মিথিলা ফারহানা মীম। যিনি একজন ছাত্রী হওয়া স্বত্ত্বেও কাজ করছেন হ্যান্ডপেইন্ট নিয়ে। শুধু হ্যান্ডপেইন্ট ই নয়,পাশাপাশি কাজ করছেন সুই-সুতার নকশায় তৈরিকৃত পোশাক নিয়ে। এই পর্বে আমরা জানবো তার উদ্যোক্তা জীবনের পুরো জার্নিটা। উদ্যোক্তা মিথিলা ফারহানা মীমঃ আসসালামু আলাইকুম। আমি মিথিলা ফারহানা মীম। আমার জন্মস্থান পাবনা জেলার ঈশ্বরদী শহরে। আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। আমার দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে আমিই সবার ছোট। আমার পড়ালেখা, আমার বড় হওয়া সম্পূর্ণ ঈশ্বরদী শহরেই। আমি বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যাল থেকে রসায়নে অধ্যয়নরত রয়েছি। ২০১৭ সালে আমি এস.এস.সি পরীক্ষা দেই। আমার বেশ কিছু পরীক্ষা থাকাকালীন সময়ে আমি কিছু বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করি। ▶ আরও পড়ুনঃ কুকিজ বানিয়ে সফল নারী উদ্যোক্তা মোসাম্মত মাহ্জাবীন ! এতে আমার ভাইয়া কিছুটা রেগে যান। কারন, এস.এস.সি পরীক্ষা এখনো শেষ হয়নি সেই জন্য। কিন্তু ছোট বেলা থেকেই কেন জানিনা আমার স্বপ্ন ছিল আমি স্বাবলম্বী হবো। আমার এখনো মনে পড়ে, আমি খেলার ছলে স্বপ্ন দেখতাম আমি ঘরের কাজ সামলে চাকরি করতে যাচ্ছি। আমার ফুফুদেরকে খুব একটা কাছ থেকে দেখিনি। বাবা চাকরি করতেন বলে আমাদের আলাদা থাকতে হতো। তবে আমার দুই ফুফু সেই সময়ই চাকরি করতেন। হয়তো সেখান থেকেই আমার মনে স্বাবলম্বী হওয়ার ইচ্ছেটা। ছবিঃ সুই-সুতার নকশা করা পাঞ্জাবী ! নিজে কিছু করার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণাঃ আমি এইচ.এস.সি পরীক্ষার পর থেকেই চাকরির জন্য ভাবতাম কিন্তু চাকরির কথা যতই ভাবি ততই যেন মনে হয় চাকরি নামক সোনার হরিণটাই আমার থেকে আরো দূরে সরে যাচ্ছে। ইচ্ছে ছিলো নার্সিং করবো। সেখানেও কোনো এক কারণে স্বপ্নটা ভেঙে যায়। আমার আম্মু ও আপু দু’জন ই অনেক সুন্দর হাতের কাজের নকশা জানেন। তারা সব সময়ই আমাকে বলতেন তুমি এগুলো শিখো, তোমার ভবিষ্যতে কাজে দিবে। কিন্তু আমি একটু জেদী ধরনের। তাই যেটা না বলবো সেটা না ই হয়। আমি ভাবতাম সেই চাকরির ই কথা। আমার দ্বারা কখনো সেলাই হবে না। এগুলো আদিম যুগের কাজ। তাই কখনো তেমন মাথা ঘামাইনি এই কাজগুলোতে। ▶ আরও পড়ুনঃ সৃজনশীল নারী উদ্যোক্তা নাহিমা খন্দকার তরু ! কিন্তু আমার আপু আর আম্মুকে দেখতাম ছোট থেকেই অনেকের ই কাস্টমাইজ করা শাড়ী-কাঁথা-পাঞ্জাবীর নকশা করতেন। তারপর আপুর বিয়ে হয়ে যায়। আর আম্মুও কাজগুলো বন্ধ করে দেন। আপুর বিয়ের ৫ বছরের মাথায় দুলাভাই একটা এক্সিডেন্টে মারা যান। কিন্তু আমার আপু এতটাই সহজ-সরল, নরম মনের মানুষ যে তিনি বাহিরে গিয়ে কিছুই করতে পারেন না। বলে রাখা ভালো, আপু গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করেছেন। আর এখন দুই বাচ্চা নিয়ে বসেই আছেন। তখন থেকেই আমার মনে হতে থাকে, আমার কিছু একটা করতেই হবে। এমন বদ্ধজীবন আমি চাই না। তারপর ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে আমার এক বান্ধবী আমাকে উই গ্রুপে জয়েন করায়। ওখানে অনেক আপুদের ই জীবনের গল্প পড়তাম। দেখে খুব ভালো লাগতো। তারা আজ সফল। সেখান থেকেই মনে হত, তাহলে আমিওতো কাজগুলো শিখতে পারি। তখন কোন প্রকার মাপ ছাড়াই শুধু মেশিনের কাঁচিটা হাতে নেওয়া শিখেছিলাম। ছবিঃ হ্যান্ডপেইন্টের কূর্তি ! উদ্যোক্তা পথ বেছে নেওয়ার কারণঃ তাৎক্ষণিকভাবে মনে হয়েছিল আমিও কাজ করবো। আর উইয়ের সব আপুদের মত আমারও বলার মতো একটা গল্প থাকবে। তবে এখনো বলার মতো গল্প সেভাবে তৈরি করতে পারিনি। একটু একটু করেই এগুচ্ছি। আমি সব সময়ই মন যা বলে তাই করি। কারো কথা শুনি না। হঠাৎই মনে হয়েছিল নিজের একটা পরিচয় তৈরি করার জন্য চাকরির চেয়ে উদ্যোক্তা হওয়াটাই বেশি জরুরী। আর তখনই এই সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি হ্যান্ডপেইন্ট নিয়ে শুরু করেছিলাম একদম শুন্য থেকে । আজও তেমন কিছু করে উঠতে পারিনি। তবে আমার নিজস্ব ডিজাইন রয়েছে। আমি এখন কাজ ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারি না। সুই-সুতা আর রংতুলি এখন আমার নেশা। যে সুই-সুতাকে একসময় আমি এড়িয়ে চলতাম আজকে সেই সুই-সুতাই আমার স্বপ্ন, আমার নেশা, আমার পেশা। উদ্যোক্তা জীবনের শুরুঃ ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের ৮ তারিখে আমার পেইজটা খোলা হয়। আমি তেমন কিছুই বুঝতাম না। ঝোঁকের বসে আম্মুকে আর আপুকে বলেছিলাম, “তোমাদের কাজ করা যত পন্য আছে সব কিছু আমাকে দাও, আমি ছবি তুলবো”। আমার বাসায় নকশী কাঁথা, নকশী শাড়ী. কারচুপি শাড়ী, কারচুপির জামা, ওয়ালমেটসহ অনেক কিছুই ছিলো। সেগুলোরই ছবি তুলেছিলাম সেদিন। তারপর আম্মুকে বলি, “আমি কাজ শুরু করতে চাচ্ছি”। আম্মু তখন ২টা জামার কাপড়ের টাকা দিয়েছিলো। তা দিয়েই শুরু হয় আমার উদ্যোক্তা জীবন। ▶ আরও পড়ুনঃ কিশোর উদ্যোক্তা রাফি ইসলাম রিশাদ ! শূন্য হাতে কাজ শুরু করেছিলাম। আমি জামার কাজে তেমন সাড়া পাইনি। আমার সেল হতে শুরু করে ঈদের মধ্যে। প্রতি মাসে একটা, দুইটা করে জামার কাপড় কিনতাম। এভাবে আমার ৫টা হাতের কাজের ওয়ান পিস তৈরি করা হয়। ঈদের মধ্যে আম্মু ৩টা নেয় আমাদের জন্য আর ভাবীর জন্য। আর বাকি ২টা থেকে আমার ফুফাতো বোন ঈদে আমাদের বাসায় ঘুরতে এসে সেই ২টাও নিয়ে যায়। আলহামদুলিল্লাহ সেই থেকে আমার সেল শুরু হয়। রোজার ঈদ চলে যাওয়ার পর দুই থেকে তিন দিনের মাথায় এক ভাইয়া আমার নকশা করা বেবী ড্রেসের দাম জানতে চান। তারপর সঙ্গে সঙ্গেই তার ভাতিজীর জন্য কনফার্ম করে পুরো টাকাটা এডভান্স পেমেন্ট করে দেন। সেই দিনটি আমার জন্য এতটাই আনন্দের ছিলো যে, তা বলে বোঝানো সম্ভব না। বলতে গেলে সেটাই ছিলো আমার প্রথম অর্ডার। তারপর থেকে দেশের বাহিরে থেকেও অর্ডার আসতে শুরু করে। আমার প্রথম ক্রেতাই আমাকে পাঞ্জাবীতে হ্যান্ডপেইন্টের নকশা করতে বলেন। আল্লাহর অশেষ রহমতে সেই ১টা পাঞ্জাবীতেই আমার কপাল খুলে যায়। সেই ভাইয়ার অর্ডারই কোরবানী ঈদের মধ্যে থাকে প্রায় ১৫ হাজার টাকার। সেইম পাঞ্জাবী উনারা কয়েকজন বন্ধু মিলে একসাথে নেন। সেই পাঞ্জাবীগুলোই প্রথম বারের মতো দেশের বাহিরে যায়। ছবিঃ হ্যান্ডপেইন্ট পাঞ্জাবী ! আমার প্রাপ্তিঃ এই এক বছরে হয়তো আমার লাখ টাকার সেল হয়নি কিন্তু জীবন আমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছে। এখন আমি বেঁচে থাকার মুল্য বুঝি। কাজ, ব্যস্ততা আমাকে এমন একটা জায়গা দিয়েছে যে, আমি এখন ভালো থাকাটা কাজের মধ্যে পেয়ে গিয়েছি। এত এত মানুষের ভালোবাসা পাবো, সুনাম পাবো কখনো কল্পনাও করিনি। তবে এখন মিথিলা মীমকে কলেজে কেউ দেখলেই বলে, “এই তুমি মিথিলা মীম না? হাতের কাজ ও হ্যান্ডপেইন্ট কর” ! সত্যি বলতে এগুলো শুনতে অনেক গর্ব হয়। ▶ আরও পড়ুনঃ একজন সফল কিশোরী উদ্যোক্তা জুম্মা জাফরিন ! সারা জীবন ইচ্ছে ছিল, যে বাবা-মা আমার জন্য এতটা কষ্ট করেছে তাদের জন্য যেন কিছু করতে পারি। এখনো সেভাবে কিছুই করতে পারিনি। তবে ইনশাআল্লাহ সামনে পারবো। এখনও পর্যন্ত ৫৫+ হ্যান্ডপেইন্ট ও হ্যান্ড স্টিচ পাঞ্জাবীতে কাজ করেছি। ইনশাআল্লাহ এবারের ঈদে হয়তো সেঞ্চুরি করবে। এছাড়াও বেবী ড্রেস করেছি, ফ্যামিলি কম্বো করেছি। এখন আমার বেশির ভাগ ক্রেতাই আমার রিপিট ক্রেতা। রেফারেন্স ক্রেতাও পেয়েছি। এই সব কিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ। এবারের ঈদে ইনশাআল্লাহ লাখপতির খাতায় নাম লিখাবো। আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাঃ আমাকে আমার পরিবারের সবাই ই সাপোর্ট করেন। তেমন কোন বাঁধার সম্মুখীন হইনি। সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট করেন আমার আম্মু ও ভাইয়া। শুধু এখন একজন সফল উদ্যোক্তা হতে পারাটা আমার আম্মুর জন্য স্বপ্ন হয়ে গেছে। আমার বন্ধু-বান্ধব সকলেই আমাকে সাপোর্ট করে। আমার ইচ্ছে আছে অসহায় মেয়েদের নিয়ে কাজ করার। আমার একটা নিজস্ব শোরুম থাকবে। আমার নিজস্ব ডিজাইনের নিজস্ব পন্য থাকবে। আমি চাই অসহায় মেয়েদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করতে। বাকিটা আল্লাহ ভরসা। আমার স্বপ্ন ও আমার উদ্যোগের জন্য সকলের কাছে দোয়াপ্রার্থী। লেখকঃ উদ্যোক্তা মিথিলা ফারহানা মীম উদ্যোগঃ Mithila’s Hand Stitch Zone